দেশে কোন ধরনের পণ্য আমদানি করা যাবে আর কোন ধরনের পণ্য আমদানি করা যাবে না, তা নির্ধারিত হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী। মন্ত্রণালয়ের ওই আদেশে অবাধে আমদানিযোগ্য ফুড সাপ্লিমেন্টের (ভিটামিন, খনিজ, ভেষজ উপাদান এবং অন্যান্য পুষ্টিকর পদার্থের ঘনীভূত রূপ) চালান খালাসের প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরই মধ্যে এমন অর্ধশতাধিক চালান আটকে দিয়েছে কাস্টম হাউসগুলো। এনবিআরের শুল্ক নীতিতে ফুড সাপ্লিমেন্টের একটি মীমাংসিত ইস্যু নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে না পেরে এনবিআর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছেন কাস্টমসের দুই কমিশনার। এতে ফুড সাপ্লিমেন্টের চালান খালাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আর এই জটিলতায় পড়ে (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) পরীক্ষার পরও চার মাসের বেশি সময় ধরে বন্দরে পড়ে আছে পণ্যের চালানগুলো। আর এসব চালানের জন্য প্রতিদিন জরিমানা গুনছেন আমদানিকারকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের ২৯ মে হুট করে ফুড সাপ্লিমেন্টের চালান খালাস নিয়ে বেনাপোল কাস্টম হাউসে চিঠি দেয় এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এসব চালান খালাসের ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসনের পূর্বানুমতির বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে বলেও চিঠির মাধ্যমে জানায় এনবিআরের এই গোয়েন্দা শাখা। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ফুড সাপ্লিমেন্টের চালান খালাস বন্ধ করে দেয় কাস্টম হাউসগুলো। এরই মধ্যে বেনাপোল কাস্টম হাউস এমন ২১টি পণ্যের চালান আটকে রেখেছে। আমদানি নীতি আদেশ এবং এনবিআরের কাস্টম পলিসির আদেশ আমলে না নিয়ে এসব চালানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে না পেরে বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে চিঠি দেন। আর কাস্টমস কমিশনারের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর পূর্বানুমতি না চাওয়ায় ছাড়পত্র দেবে না বলেও জানিয়ে দেয়। যদিও আমদানি নীতি অনুযায়ী, দেশে পণ্য চালান আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো দপ্তরের সঙ্গে অসামঞ্জস্যতা তৈরি হলে বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানি নীতি আদেশে যুক্ত করবে। এ ছাড়া কোনো পণ্যের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হলে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবে। ফুড সাপ্লিমেন্টের বিষয়ে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তই নেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবুও ঔষধ প্রশাসনের ২০২৩ সালের একটি আইনের দোহাই দিয়ে মাসের পর মাস ফুড সাপ্লিমেন্টের চালান আটকে রেখেছে কাস্টম হাউসগুলো। এ ছাড়া ২০২৩ সালে এ আইন প্রণয়নের পরও চলতি বছরের শুরু পর্যন্ত এসব পণ্যের চালান খালাস হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ২০২৩ সালের ওষুধ ও কসমেটিকস আইনে ফুড সাপ্লিমেন্ট অন্তর্ভুক্ত করলেও কোন ধরনের পণ্য আমদানি করা যাবে বা কোন ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে, তা এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। অর্থাৎ গত দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটি বিধিমালা জারি করতে পারেনি। মূলত আমদানি নীতি আদেশ আমলে না নিয়ে হুট করে শুল্ক গোয়েন্দার অতি উৎসাহী কর্মকর্তা ফুড সাপ্লিমেন্টের চালান আটক করতে কাস্টম হাউসে চিঠি দেন। এতে মাসের পর মাস ধরে ভোগান্তিতে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর প্রতিদিন মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনছেন। শুধু ফুড সাপ্লিমেন্টের চালানই নয়, এর আগে মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে অবাধে আমদানিযোগ্য মিথানলের চালান আটকে রেখেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। যদিও খোদ শুল্ক কর্মকর্তারাই বলছেন, সংশ্লিষ্ট কমিশনারদের সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই মূলত এ ধরনের ভোগান্তি তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফুড সাপ্লিমেন্ট আমদানিকারক আহমেদ সানি কালবেলাকে বলেন, ‘এনবিআর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে প্রতিদিন ঘোরাঘুরি করছি। মাসের পর মাস চালান বন্দরে পড়ে আছে। এতে প্রথম ১৪ দিন ৬০ ডলার, পরবর্তী প্রতিদিন ৯৬ ডলার করে শুধু মাশুল দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া পোর্টের (বন্দর) আলাদা চার্জ তো আছেই। সব মিলে ফুড সাপ্লিমেন্ট আমদানিকারকরা মহাবিপাকে পড়েছেন। কাউকে কিছু না বলে হুট করে এমন সিদ্ধান্তের জন্য সবাই বিপাকে পড়েছেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার এইচএম কবির কালবেলাকে বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পূর্বানুমতি না থাকার কারণে ফুড সাপ্লিমেন্টের পণ্য চালান আটকে আছে। এনবিআরের নির্দেশনায়ও পণ্য চালানগুলো ছাড়ার অনুমতি নেই। আমদানি নীতি আদেশে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও ওষুধ ও কসমেটিক আইনের বাধ্যবাধকতার জন্য এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, মূলত শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের চিঠির কারণে বিপাকে পড়েছে কাস্টম হাউসগুলো। আর ফুড সাপ্লিমেন্টের আমদানিকারকরা দিনের পর দিন এনবিআরের দ্বারস্থ হয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। ফুড সাপ্লিমেন্টের চালান খালাসের ক্ষেত্রে নতুন করে আরও জটিলতা তৈরি করেছে খোদ এনবিআর। সংস্থাটির শুল্ক নীতি অণুবিভাগ একটি কৌশলী চিঠি ইস্যু করেছে কাস্টম হাউসে। ওই চিঠিতে ফুড সাপ্লিমেন্টের আমদানিতব্য চালানের ক্ষেত্রে দেশের বিধিবিধান মেনে খালাসের নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু হুট করে আটকে দেওয়া পণ্য চালানের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। এরই মধ্যে বেনাপোল কাস্টম হাউসে এমন ২১টি পণ্যের চালান চার মাস ধরে আটকে আছে। আর এসব চালানের পণ্য ঝড়-বৃষ্টিতে এবং ইঁদুরের উপদ্রবে নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া বন্দরে পড়ে থেকে পণ্যের মেয়াদও উত্তীর্ণ হতে চলেছে। সব মিলে বন্দরে পড়ে থাকা এসব চালানে সরকারও রাজস্ব পাচ্ছে না। অন্যদিকে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। শুধু বেনাপোল কাস্টম হাউস নয়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসেও ফুড সাপ্লিমেন্ট হিসেবে আসা ১১টি চালান আটকে দিয়েছেন শুল্ক কর্মকর্তারা। এনবিআরের কোনো নির্দেশনা না থাকায় আইসিডি কমলাপুরেও দুটি চালান আটকে আছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ছয় মাস আগে ছাড়পত্র দিলেও নতুন করে কোনো ছাড়পত্র দিচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটি এ-সংক্রান্ত চিঠির জবাবে জানিয়েছে, নতুন আইন অনুযায়ী ফুড সাপ্লিমেন্ট আমদানির ক্ষেত্রে পূর্বানুমতির শর্ত থাকায় আমদানির পর কোনো ছাড়পত্র দেওয়ার সুযোগ নেই। আর সরকারি দুই সংস্থার এমন অস্পষ্টতার বলি হচ্ছেন ফুড সাপ্লিমেন্ট আমদানিকারকরা। এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘শুল্ক গোয়েন্দার চিঠির কারণে বিভিন্ন কাস্টম হাউস পণ্য চালানগুলো আটকে দিয়েছে। আর এনবিআরের পক্ষ থেকে আইন মেনে খালাসের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ যদিও এসব পণ্য চালানের ক্ষেত্রে এখন ঔষধ প্রশাসন অধিপ্তরের অনুমতি নিয়েই খালাস করতে হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ নেয়াজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘ফুড সাপ্লিমেন্টের বিষয়টি বেনাপোল কাস্টম হাউসের।’ পরে শুল্ক গোয়েন্দার চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন এবং চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. শফিউদ্দিনের মোবাইল ফোনে বিষয়টি উল্লেখ করে বার্তা পাঠালেও তাদের কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।