নিজ কর্মকর্তাদের বিশেষ লকার (সেফ ডিপোজিট) সুবিধা দিত বাংলাদেশ ব্যাংক। কর্মকর্তারা তাদের অতিমূল্যবান সামগ্রী ঘোষণা না দিয়েই জমা রাখতে পারতেন সুরক্ষিত ওই লকারে। তবে এই বিশেষ সুবিধার অপব্যবহার করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে) সুর চৌধুরী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা তার এই বিশেষ লকারে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা, ১ কেজিরও বেশি স্বর্ণালংকার ও প্রায় ৭০ লাখ টাকার এফডিআরের নথিপত্র খুঁজে পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর চিঠি দিয়ে কর্মকর্তাদের সব লকার ফ্রিজ (অবরুদ্ধ) করে দুদক। তবে এবার বাংলাদেশ ব্যাংকে সেই বিশেষ লকার সুবিধা একেবারে বাতিল হতে যাচ্ছে। এ ছাড়া ফ্রিজ থাকা ৫৩২টি লকারের মধ্যে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে—সেগুলো বাদে বাদবাকি লকার খুলে দিতে দুদককে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুদকের কমিশন সভায়ও এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের লকারে তল্লাশি চালিয়ে সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর রাখা ৫৫ হাজার ইউরো, ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার জব্দ করা হয়। পাশাপাশি ৭০ লাখ টাকার এফডিআর ও প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের এক কেজি (প্রায় ৮৬ ভরি) স্বর্ণের অলংকার জব্দ করা হয়। সে সময় দুদকের আভিযানিক দল বাংলাদেশ ব্যাংকে আরও অনেক কর্মকর্তার এমন সুরক্ষিত লকারের সন্ধান পায়। এরপর চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব লকার ফ্রিজ রাখতে বলে দুদক। এ ছাড়া নতুন করে লকার বরাদ্দ বন্ধ রাখতে বলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ‘গত ২৬ জানুয়ারি আদালতের অনুমতিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনের টিম বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েন ভল্টে রক্ষিত অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরীর সেইফ ডিপোজিট তল্লাশি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে তার জমা করা তিনটি সিলগালা কৌটা খুলে ৫৫ হাজার ইউরো, ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার, ১০০৫.৪ গ্রাম স্বর্ণ ও ৭০ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া গেছে। তল্লাশিকালে রেজিস্টার পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য কিছু কর্মকর্তাও সিলগালা করে সেইফ ডিপোজিট রেখেছেন। এসব সিলগালা কৌটাতেও অপ্রদর্শিত সম্পদ থাকার অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘গত ৩০ জানুয়ারি বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের “দুদক ও সম্পদ পুনরুদ্ধার” বিষয়ক আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত সম্পদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা ওই ভল্টে রক্ষিত সম্পদ সাময়িক ফ্রিজের সম্মতি দিয়েছেন।’
এরপর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫৩২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সব লকার ফ্রিজ ছিল। সেসব লকার খুলতে গত ৯ অক্টোবর দুদকে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুদক চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্ট ম্যানুয়েল (বিডি ম্যানুয়েল)-এর ৫০২-৫০৯ ধারা এবং ‘Safe Deposit’ নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের স্বর্ণালংকারসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী নিজ নামে জমাদানের সুযোগ রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জমাকৃত Safe Deposit ফেরত প্রদান করে ওই সুবিধা বন্ধ করতে গভর্নর মহোদয় এরই মধ্যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিডি ম্যানুয়েলের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধনের প্রক্রিয়া সেফ ডিপোজিট ফ্রিজ থাকায় স্থগিত রয়েছে। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লকার (Safe Deposit) ফ্রিজ রেখে অন্যদের লকার আনফ্রিজ করার জন্য আপনাদের অনুরোধ করা হলো।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের লকার সুবিধা বাতিল হচ্ছে—এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।’ তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘লকার অতিগোপনীয়। সেখানে তো কারও পক্ষেই যাওয়া সম্ভব নয়। কর্মকর্তারা তাদের অতিমূল্যবান দ্রব্যাদি বিশেষ করে স্বর্ণ সেখানে রাখেন। কোনো কর্মকর্তা কোনো কিছু রাখতে চাইলে সংশ্লিষ্ট বিভাগে আবেদন করেন। এরপর সেই বিভাগে তার জিনিসপত্র কোনো পাত্রে—ধরেন আইসক্রিমের বাটিতে ভরে, প্লাস্টিকে মুড়িয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগে জমা দেন। সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে সেটি লকারে রাখা হয়। এরপর প্রয়োজন হলে আবার সেই বিভাগে জানালে তারা নির্দিষ্ট দিনে খুলে সেই কৌটা তাদের হাতে দেন। তারা সেটি বাসায় নিয়ে প্রয়োজনীয়টা রেখে বাকিটা পরে বা ব্যবহার শেষে একই প্রক্রিয়ায় ব্যাংকে জমা দেন। লকার খুবই ছোট, সেখানে অনেক বেশি কিছু রাখাও সম্ভব নয়। একটা আইসক্রিমের বাটিতে আর কী রাখা যায়?’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুখপাত্র আরও বলেন, ‘এসব লকারে সাধারণত কর্মকর্তারা স্বর্ণই রাখেন। এখন স্বর্ণের যেই দাম, সেই অবস্থায় তো বাসায় রাখা নিরাপদ নয়। এখন এই সুবিধা যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তা আমাদের জন্য বেদনাদায়ক।’
যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্তে কোনো আপত্তি নেই উল্লেখ করে আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করা হোক। সেটা নিয়ে তো আমাদের কোনো আপত্তি নেই, আমরা তাদের সহযোগিতা করব; কিন্তু ঢালাও সবার লকার ফ্রিজ করা বা এই সুবিধা বাতিল হওয়া দুঃখজনক।’
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে দুদক। কমিশনের ২৪/২০২৫ তম সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দুদক থেকে গত ৩০ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। যাতে বলা হয়, ‘অবৈধ সম্পদ জমা রাখার সুযোগ হ্রাস, স্বচ্ছতা বৃদ্ধির নিমিত্তে বাংলাদেশে আর কোনো প্রাইভেট ভল্ট না রাখা এবং প্রাইভেট ভল্ট স্থায়ীভাবে বন্ধ করার জন্য ভল্ট খোলার সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন ও বিএফআইইউর একজন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকার বিষয়ে এ কমিশন কর্তৃক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।’
জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমাদের বলা হয়েছে তারা সব লকার সুবিধা বাতিল করে দিতে চান। যে কারণে তারা ফ্রিজ থাকা লকার খুলতে চান। কমিশনের সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের লকার বাদে বাকিগুলো আনফ্রিজ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুদক থেকে পরে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিষয়টি জানানো হয়েছে। আমরা বলেছি, লকার খোলার সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিএফআইইউর একজন করে প্রতিনিধি উপস্থিত রাখতে হবে।’
কতগুলো লকার আনফ্রিজ (উন্মুক্ত) করা হবে জানতে চাইলে দুদকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে, সেটার তালিকা হচ্ছে। তালিকা করতে কমিশন থেকে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়েছে। হয়তো সপ্তাহখানেকের মধ্যে হয়ে যাবে। এরপর বাকি প্রক্রিয়া।’
দুদকের আরও এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। দুদক হয়তো অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে বাকিদের আনফ্রিজ করে দেবে।’
লকার সিস্টেম বাতিল হওয়াকে দুদকের সফলতা উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘লকারে কি রাখা হচ্ছে, সেটা যে ব্যক্তি রাখেন, তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। এই সুযোগে অনেক অসৎ কর্মকর্তার তাদের অবৈধ সম্পদ বা অবৈধ সম্পদের নথিপত্র সেখানে রাখার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। দুদকের অভিযানে এসকে সুরের লকারে বিপুল পরিমাণে অবৈধ সম্পদ পাওয়ার পরে সব লকার ফ্রিজ করা হয়। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক লকার সুবিধাই বাতিল করছে। আমরা মনে করছি, এর ফলে অসৎ কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ গচ্ছিত রাখার আরও একটি নিরাপদ জায়গা বন্ধ হলো।’
যেভাবে মেলে লকারের খোঁজ: বাংলাদেশ ব্যাংকের অতি গোপনীয় এই লকারের বিষয়টি সামনে আসে যখন দুদক এসকে সুরের অতি গোপনীয় লকারের সন্ধান পায়। অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট দুদকের একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘এসকে সুরের বাসায় অভিযান চালিয়ে আমরা কিছু স্বর্ণালংকার পাই। ওই সময় এসকে সুরের স্ত্রী ও মেয়ের ছবি টাঙানো দেখতে পাই দেয়ালে। তাদের গায়ে তখন বিপুল পরিমাণে স্বর্ণালংকার পরা ছিল। আমরা অভিযানে পাওয়া স্বর্ণের সঙ্গে ছবির স্বর্ণগুলো মিলিয়ে অমিল দেখতে পাই। তখন আমরা এসকে সুরের স্ত্রীকে বলি—আপনাদের এই স্বর্ণগুলো কোথায় রেখেছেন সেটা আমাদের বলেন। যদি বলেন, তাহলে আমরা সব স্বর্ণ তালিকা করে আপনাদের কাছেই রেখে যাব। আপনারা ব্যবহার করতে পারবেন। আর না বললে এগুলো জব্দ করে নিয়ে আদালতে জমা দিয়ে দেব। তখন তারা বলেন, ‘আমাদের এই স্বর্ণ তো বাংলাদেশ ব্যাংকের লকারে রাখা।’ এরপর আদালতের অনুমতি নিয়ে আমরা তার লকার খুলে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রাসহ ১ কেজিরও বেশি স্বর্ণ জব্দ করি। এ ছাড়াও ৭০ লাখ টাকার এফডিআরের নথিপত্রও পাওয়া যায় সেই লকারে। এই অভিযানের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের রেজিস্টারে আরও অনেক কর্মকর্তার লকারের খোঁজ মেলে।’
লকারে হাত দেওয়ায় দুদক থেকে সরানো হয় সায়েমুজ্জামানকে:
বাংলাদেশ ব্যাংকের লকারে হাত দিয়ে ‘হাত পোড়ে’ দুদকের তৎকালীন পরিচালক (উপ-সচিব) কাজী সায়েমুজ্জামানের। এসকে সুরের লকার খুলতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অগণিত কর্মকর্তার লকারের সন্ধান পায় দুদক। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৩ শতাধিক কর্মকর্তার লকার খোলার কথা জানায় দুদক। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুসন্ধান তদারকি কর্মকর্তা কাজী সায়েমুজ্জামানের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দেওয়া হয়। অভিযোগটি আমলে নিয়ে প্রথমে তাকে ওই অনুসন্ধান থেকে সরিয়ে দেয় দুদক। এরপর দুদক থেকে সরিয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। সম্প্রতি দুদকের এই আলোচিত পরিচালককে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক হিসেবে বদলি করা হয়েছে। কাজি সায়েমুজ্জামানকে সরিয়ে দেওয়ার পরে ওই অনুসন্ধান আর আলোর মুখ দেখেনি। লকার-সংক্রান্ত ওই অনুসন্ধানটি দুদকের ‘ডিপ ফ্রিজে’ চলে যায়।
যে ৩ শতাধিক কর্মকর্তার লকার খোলার কথা ওই সময় খোদ দুর্নীতি দমন কমিশন থেকেই জানানো হয়েছিল—সেই লকার আর খোলা হয়নি। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে—সেগুলো বাদে বাকিদের লকার আনফ্রিজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।