Image description
ক্রীড়াঙ্গনে অনিয়ম

‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’—কথাটা দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বেশ খাটছে। ‘নারী ক্রীড়াবিদদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ’ স্লোগানও কিতাবে আছে, বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই। বরং রক্ষকই এখানে ভক্ষকের ভূমিকায়!

ওপরের কথার সঙ্গে যদি আপনি দ্বিমত পোষণ করেন, আসুন বিষয়টি আরও স্পষ্ট করা যাক—নারীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘অভিযোগ কমিটি’ গঠনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) ১২ নভেম্বর সব ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনে নির্দেশনা জারি করেছে। এটা সেই এনএসসি, যে সংস্থা ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারে গঠিত সার্চ কমিটির সুপারিশ এবং নিরাপত্তা চেয়ে নারী শুটারদের আকুতি উপেক্ষা করে জি এম হায়দারকে শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদকের চেয়ারে বসিয়েছে! এনএসসির নির্দেশনা অনুযায়ী শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশন যদি নারী ক্রীড়াবিদদের সুরক্ষায় কমিটি গঠন করে, সেখানে হয়তো মতামত থাকত সেই জি এম হায়দারের, যার বিরুদ্ধে নারী শুটারদের হেনস্তার অভিযোগ আছে। যদিও সে অভিযোগ অস্বীকার করে একাধিক শুটারের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করেছেন জি এম হায়দার। তার সঙ্গে এক নারী শুটারের ইঙ্গিতপূর্ণ কথোপকথনের কলরেকর্ড ফাঁস হয়েছিল! সেগুলো সামনে আসছে।

বিভিন্ন ঘটনা ও রেফারেন্স সামনে আনা শুটার তাসমিয়াতি এমার অভিযোগ, ‘কমিটি গঠনের আগে ২০২৪ সালের ৮ অক্টোবর ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারে গঠিত সার্চ কমিটির কর্মকর্তারা শুটিং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। শুটারদের প্রতিনিধি হয়ে সেখানে আমি বলেছিলাম—‘যাদেরই দায়িত্ব দেওয়া হোক, শুটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি যাতে অগ্রাধিকার পায়। এমন ব্যক্তি যেন না আসেন, যার কাছে শুটাররা নিরাপদ নন।’ এমন দাবির প্রতিক্রিয়ায় উদীয়মান এই শুটারকে এসএ গেমসের জন্য জাতীয় দলের ক্যাম্পের বাছাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে দাবি তাসমিয়াতি এমার, ‘জাতীয় দলের ক্যাম্প শুরু হয়েছে, আমি সেখানেই নেই—এটা দেখে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমি যে ক্লাবকে প্রতিনিধিত্ব করি, সেখানে যোগাযোগ করেছি। আমাকে বলা হলো, সার্চ কমিটির সামনে তুমি যে কথা বলেছিলে, এ কারণে বর্তমান কমিটির কর্মকর্তারা তোমার ওপর ক্ষুব্ধ।’ এ প্রসঙ্গে জিএম হায়দার বলেন, ‘বিগত দিনে যারা নানাভাবে আধিপত্য বিস্তার করছিল, তারা এখন সেটা করতে পারছে না। পাইপলাইনে প্রতিভাবান নতুন শুটার এসেছে, তারা খুব ভালো নৈপুণ্য করছে। এ কারণে অস্তিত্বের প্রশ্নে অনেকে দিশেহারা হয়ে নানা কথা বলছেন।’

তাসমিয়াতি এমার এমন দাবির পরও যদি রক্ষককে ভক্ষক ভাবতে আপনার আপত্তি থাকে, তাহলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। কালবেলার হাতে ১৭ মিনিট ৩২ সেকেন্ডের একটি কলরেকর্ড আছে। যার এক প্রান্তে জি এম হায়দার, অন্য প্রান্তে এক নারী শুটার। সেখানে জি এম হায়দারের কথোপকথন ছিল ইঙ্গিতপূর্ণ। কিছু ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যও পরিষ্কার হয়েছে। কথোপকথনে জি এম হায়দারের কিছু অংশ ছিল এমন—‘তোমার সঙ্গে তো কথা হয়েই যাচ্ছে, তোমার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক, কী বোঝাপড়া—এটা নিয়ে তো আমার কোনো সন্দেহ নেই। এখন এটা থেকে ঠিক পথে চলতে হবে। কারণ, আমরা অনেক দূর হাঁটতে চাই। এখানে অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম আছে। সেখানে যেতে হলে কিছু বাধা আসবে। বাধা অতিক্রম করে হাঁটতে হবে পাবলিকলি প্রতিষ্ঠিত না করে।’

জি এম হায়দার সে সময় আরও বলেন, ‘যদি কোনো জরুরি কথা থাকে, আমি যদি তোমাকে বলি একান্তে কিছু কথা বলতে চাই। তুমি যদি বল ঠিক আছে, আপনি আম্মুর সঙ্গে কথা বলেন। তুমি এটা বললে আমি বুঝে নেব…’ কথোপকথনের একপর্যায়ে জি এম হায়দার বলেন, ‘তোমার যদি একান্তে কথা থাকে, আমাকে মেসেজ দেবে। আমি যদি তোমাকে আম্মু বলি তুমি বুঝে নেবে আমি লোকজনের মাঝে আছি। তখন তুমি বলবে—মামা আপনি যে এক্সারসাইজ দিয়েছিলেন, এটা আমি করব কি করব না। আমার লক্ষ্মীটা অনেক বড়, অনেক পরিণত। গতকাল আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি।’

একদিকে ওই কলরেকর্ডের প্রমাণ, অন্যদিকে শুটার এবং শুটিং সংশ্লিষ্টদের দাবি—‘যাকেই দায়িত্ব দেওয়া হোক আপত্তি নেই, তবে এমন কাউকে যেন গুরুত্বপূর্ণ পদে না রাখা হয়; যার কাছে নারী শুটাররা নিরাপদ নন।’ দুইয়ের যোগফলে সার্চ কমিটির কর্মকর্তারা একমত হয়েছিলেন, ‘শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের কমিটিতে কোনোভাবেই জি এম হায়দারকে রাখা যাবে না।’ সার্চ কমিটি জি এম হায়দারের অতীতও পর্যবেক্ষণ করেছে। ঢাকা রাইফেলস ক্লাবে দুর্নীতি ও অনিয়মের একাধিক অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ঢাকা রাইফেলস ক্লাবের সদস্য মো. আবু সাদেককে পিটিয়ে রক্তাক্ত করার ঘটনায় মামলাও হয়েছিল জি এম হায়দারের বিরুদ্ধে। সে মামলায় তিন বছরের সাজাও হয়েছিল, করতে হয়েছিল কারাভোগ। পরে জামিনে মুক্ত হয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি এনএসসিতে জি এম হায়দার ও সাবেক শুটার শারমিন আক্তারের বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন শুটার কামরুন নাহার কলি।

অভিযোগ আছে, জিএম হায়দারকে শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনে পদায়নের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের অর্থের যোগসাজশ ছিল। সে কারণেই সার্চ কমিটির সুপারিশ করার পরও মাসের পর মাস আটকে রাখা হয়েছিল দেশের ক্রীড়াঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ এ ফেডারেশনের কমিটি। শেষ পর্যন্ত যে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে শুটারদের দাবি উপেক্ষা করা হয়েছে, অগ্রাহ্য করা হয়েছে সার্চ কমিটির সুপারিশকে।

এখানে আরও একটি কারসাজি ছিল—আগামী ২৯ ডিসেম্বর যার বয়স ৭৮ পূর্ণ হবে, সেই আলেয়া ফেরদৌসিকে সাধারণ সম্পাদক করা। বয়স এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে বর্ষীয়ান এ সংগঠক ফেডারেশনে সময় দিতে পারবেন না—এটা পরিষ্কার ছিল। সাধারণ সম্পাদকের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন যুগ্ম সম্পাদক জিএম হায়দার। আদতে হয়েছে তাই। গঠিত অ্যাডহক কমিটি দায়িত্ব গ্রহণের পর আলেয়া ফেরদৌসি শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনে খুব বেশি সময় দিতে পারেননি, ছিলেন বিদেশে। সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন বর্ষীয়ান এ সংগঠক। সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতেও শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনে প্রভাব বিস্তার করেন সাবেক এ শুটার—জানিয়েছে খেলাটির ঘনিষ্ঠরা।

আরেক শুটার কামরুন নাহার কলির দাবি, তুচ্ছ ঘটনায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছিল আমাকে। জবাবকে ‘সন্তোষজনক নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের চিঠিতে। যার অর্থ কামরুন নাহার কলি শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে ‘অপরাধী’। তারপরও এ শুটারকে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগদানের কথা বলা হয়। সেই চিঠিতে আবার উল্লেখ করা হয়েছিল—‘প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগদানের আগে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পরবর্তী নির্দেশনা গ্রহণ করবেন।’

এ প্রসঙ্গে কামরুন নাহার কলি বলছিলেন, ‘ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার পর আমি তাকে (জি এম হায়দারকে) দেখে বলেছি, আঙ্কেল আমি তো চলে এসেছি। তিনি বললেন, তোমার প্রতি আমি কিন্তু সন্তুষ্ট না। তুমি একটু দেখা করো। আমি বলেছি, এই তো দেখা হয়ে গেল। আবার কী দেখা করব? তিনি বললেন—না, তুমি দেখা করো।’ কামরুন নাহার কলি আরও বলেন, ‘আমি তার ইঙ্গিতপূর্ণ কথার ব্যাখ্যা চাইনি। কারণ আমি হতাশ হয়েছি, বিব্রতবোধ করেছি।’ এ প্রসঙ্গে জি এম হায়দার বলছিলেন, ‘সাধারণ সম্পাদক দেশে ছিলেন না, আমি কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করেছি। তখন ছুটি চেয়েছিল কলি, আমি সেটা মঞ্জুর করিনি। আমি তাকে আম্মু ডাকি, সে আমাকে চাচা ডাকে। এখানে কী আর বলব!’

বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি কালবেলাকে বলেন, ‘এখন নৈপুণ্য নয়, জি এম হায়দারের মর্জিই শুটার মনোনয়নের মানদণ্ড। এটা খুবই হতাশার বিষয়। জিএম হায়দার খুব আক্রমণাত্মক, এ কারণে ফেডারেশনের অভ্যন্তরে কেউ তার মনগড়া কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সবার ধারণা ছিল, অতীতের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে এ যাত্রায় জিএম হায়দার হয়তো নিজেকে শোধরাবেন। কিন্তু আদতে হয়েছে উল্টো।’

এনএসসির ভূমিকা এবং শুটিং ফেডারেশনের অভ্যন্তরের নানা ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু শেষ কথা নয়। বর্তমান ক্রীড়াঙ্গনে নারী ক্রীড়াবিদদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে আওয়াজ উঠেছে, তার সূত্রপাত ক্রিকেটে জাহানারা আলম ইস্যু থেকে। এ ক্রিকেটারকে রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব ছিল, তাদের অন্যতম সাবেক ক্রিকেটার মঞ্জুরুল ইসলামের দিকেই অভিযোগের তীর। সাঁতারে এক নারীকে হয়রানির অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়েছেন কোচ আলমগীর হোসেন। ২০১১ সালে নিপীড়নের শিকার হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন প্রতিশ্রুতিশীল সাঁতারু আরিফা আক্তার; ওই ঘটনায় অভিযোগের তীর ছিল কোচ এমদাদুল হকের দিকে।