Image description

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ ও গণভোটের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো ঐকমত্য হয়নি। গণভোটের ‘সময়’ ও ‘প্রশ্নের ধরন’ এবং জারিকৃত ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’-এর বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলো এখনো তাদের ভিন্নমত তুলে ধরছে। একই দিনে গণভোট এবং নির্বাচন ঘোষণায় বিএনপি অনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। তবে গণভোটের যে চারটি প্রশ্নের বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে তা নিয়ে দলটি আপত্তি জানাচ্ছে। তারা গণভোটের প্রশ্নের পরিবর্তন চাচ্ছে। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলনরত আট দলও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য প্রেসিডেন্টের আদেশ জারির জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছে। অন্যদিকে, তারা জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে করার সিদ্ধান্তকে পুর্নবিবেচনার দাবি জানাচ্ছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের মতপার্থক্য থাকার পরও সবাই নির্বাচনের মাঠে পুরো সক্রিয় রয়েছে। সব দলের মধ্যেই নির্বাচনের জন্য চলছে সার্বিক প্রস্তুতি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট প্রধান দলগুলোর দাবি ও মতামতের সমন্বয় ঘটিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যেই সিদ্ধান্ত সরকার ঘোষণা করেছে, সেটি দলগুলো কার্যত মেনে নিয়েছে। কারণ, এতে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ সব দলেরই কোনো না কোনো চাওয়া পূরণ হয়েছে। আর দলগুলোও এখন নির্বাচনের মাঠে নেমে পড়েছে। দেশে নির্বাচনের হাওয়া পুরোদমে বইতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে যেসব বক্তব্য দিচ্ছে এটি তাদের নির্বাচনী কৌশল মাত্র। সরকার এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকে চাপে রেখে নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্যই তাদের এই পরস্পর-বিরোধী বক্তব্য।

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, দেশে নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সব রাজনৈতিক দল এখন নির্বাচনের মাঠে রয়েছে। তবে তারা যেসব বিষয়ে পরস্পর-বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে বা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছেÑ এগুলো হলো তাদের রাজনৈতিক কৌশল। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই, সরকারকে তা করতে হবে। প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করতে হবে। এসব দাবি রাজনৈতিক দলের থাকবেই। সরকারকে চাপে রাখার জন্য তারা এসব দাবি করে নিজেদের কিছু সুবিধা আদায় করতে চাইবে, এটিও একটি রাজনৈতিক কৌশল। এসব কৌশলের মধ্য দিয়েই দলগুলো নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ও গণভোটের বিষয়টি ঘোষণার পর আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি একেবারেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। এরপর বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি ও গণতন্ত্র মঞ্চসহ সব দলই ভোটের মাঠে আরো তৎপর হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনও (ইসি) আগামী ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ জন্য ইসি ১৮ নভেম্বর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করতে পারে। ইসি সূত্র মতে, আগামী বছরের ৫ অথবা ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ধরেই সব প্রস্তুতি চলছে। সংসদ ও গণভোট একই দিনে করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসায় নির্বাচন কমিশনকে বাড়তি কিছু প্রস্তুতি এখন নিতে হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে ঘোষিত সিদ্ধান্তসমূহ এবং প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের জারিকৃত আদেশ অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গেই একত্রে পৃথক ব্যালটে গণভোট হবে, আগামী জাতীয় সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট ‘নি¤œকক্ষ’ ও ‘উচ্চকক্ষ’, নি¤œকক্ষের নির্বাচন বিদ্যমান ব্যবস্থাতেই হবে, তবে ১০০ সদস্যের ‘উচ্চকক্ষ’ গঠন হবে ‘নি¤œকক্ষে’ দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে। এসব সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে সন্তোষ-অসন্তোষ থাকলেও দলগুলোর কেউই তা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেনি। বিএনপি প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। জামায়াত ও চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি দল কিছুটা অসন্তোষ জানালেও আন্দোলনের বড় কর্মসূচিতে তারা যাচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনায় অবস্থান গ্রহণের কর্মসূচি থেকে ইতোমধ্যে তারা সরে এসেছে। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার জানিয়েছেন, তাদের লিয়াজোঁ কমিটিতে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি জানানো হবে। এনসিপি আদেশের বিষয়ে সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে, তবে আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি দেয়নি। তারা অবশ্য জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি চায়। সেটি পূরণ হতে চলেছে।

রাজনৈতিক দলগুলো দৃশ্যত কিছুটা মত, কিছুটা অমতÑ এমন ধাঁচের প্রতিক্রিয়া দেখালেও মূলত সব দলই এখন নির্বাচনমুখী। গত ৩ নভেম্বর বিএনপি ২৩৭টি আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। যদিও পরে একটি আসনে মনোনয়ন স্থগিত করা হয়। দলের মনোনয়নপ্রাপ্তরা এরপর থেকে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছেন। প্রতিদিনই গণসংযোগ, সভা-সমাবেশ ও উঠান বৈঠক করছেন। ভোটারদের ঘরে ঘরেও যেতে শুরু করেছেন। রাজধানীসহ সারা দেশেই বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে ভোট চেয়ে পোস্টার-ব্যানার সাঁটিয়েছেন। প্রার্থীদের বেশির ভাগই দলের ৩১ দফা কর্মসূচি সম্বলিত লিফলেট বিতরণ করছেন। যেসব আসনে বিএনপি এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি, সেসব আসনেও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নানাভাবে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। সব মিলিয়ে নির্বাচনী মাঠে বিএনপি এখন পুরোপুরি সক্রিয় রয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দেশের মানুষ নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। বিগত তিনটি নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারেনি। বিশেষ করে, একটি প্রজন্ম যারা নতুন ভোটার তারা একটি নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। সারা দেশের মানুষ নির্বাচনের পক্ষে। আমরা এলাকায় গেলে মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখছি। নির্বাচনের ব্যাপারে সবার ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। তাই আমারা এখন আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য পুরো প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছি।

সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি এখনো জারি রাখলেও জামায়াতসহ তাদের আন্দোলনের সহযাত্রী আট দল নির্বাচনের জন্য পুরো প্রস্তুতি নিচ্ছে। জামায়াত ইতোমধ্যেই ২৯৯টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। গত প্রায় এক বছর ধরে বেশির ভাগ আসনে দলটি প্রার্থীর নাম সভা-সমাবেশে করে ঘোষণা দিয়েছে। জামায়াতের প্রার্থীরা রাজধানীসহ সারা দেশেই ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীকে ভোট চেয়ে পোস্টার সাঁটিয়েছেন। প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় নির্বাচনী সভা-সমাবেশসহ নানাভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। দলটির নারী কর্মীরা দলের লিফলেট নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, উঠান বৈঠক করছেন। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, চলতি মাসেই জামায়াত আনুষ্ঠানিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে।

জারিকৃত ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ নিয়ে নানা আপত্তি তুললেও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার নিজেই গত ১৫ নভেম্বর নিজ নির্বাচনী আসনে (খুলনা-৫, ডুমুরিয়া-ফুলতলা) নির্বাচনী শোভাযাত্রা ও পথসভা করেছেন। খুলনার জিরো পয়েন্ট এলাকায় এক পথসভায় তিনি প্রশাসনের প্রতি নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা আগামী নির্বাচন স্বচ্ছ করুন। প্রত্যেক প্রার্থী যেন সমান সুযোগ পেয়ে নির্বাচনী কাজ করতে পারেন। এ ছাড়া গতকাল আট দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল দেশবাসীর প্রতি হ্যাঁ ভোট দেয়ারও আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত বলেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য আন্দোলন করছি। আমাদের আন্দোলনের জন্য জুলাই সনদ আইনি ভিত্তি পেতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট আদেশ জারি করেছেন। এখন আমরা রাষ্ট্রের সংস্কারের জন্য দেশবাসীকে হ্যাঁ ভোট দেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।

জামায়াতের অন্যতম নির্বাচনী মিত্র চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও প্রায় এক বছর ধরেই আসনে আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করছে। দলটির প্রার্থীরা অনেক আগেই ‘হাতপাখা’ প্রতীকে ভোট চেয়ে এলাকায়-এলাকায় পোস্টার-ব্যানার লাগিয়েছেন। প্রার্থীরা প্রায় প্রতিদিনই নিজ এলাকায় পথসভা ও শোভাযাত্রা করছেন। চালাচ্ছেন প্রচারণা ও গণসংযোগ। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা রুটিন করে দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী সভা-সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতিতে আলোচিত এনসিপিও ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করছে। ডাকডোল বাজিয়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ফরম সংগ্রহ করছেন। আগামী ২০ নভেম্বর এই ফরম বিক্রির কাজ শেষ হবে। এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি দলটির নেতারা বিএনপি, জামায়াত ও সমমনা অন্য ৯টি দলের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন জানিয়েছেন, এ মাসেই এনসিপি প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করবে। দলটির নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, আগামী নির্বাচনে ‘ধানের শীষ’-এর সঙ্গে লড়াই হবে ‘শাপলা কলি’র।

নুরুল হক নুরের গণঅধিকার পরিষদ, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন ও মজিবুর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিও ইতোমধ্যে দলীয় প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। দলটির মনোনীত প্রার্থীরাও নিজ এলাকায় নির্বাচনী গণসংযোগ করছেন। গণঅধিকার পরিষদ ও গণসংহতি আন্দোলন আসন সমঝোতার বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদের এলডিপি, বিএনপি মিত্র জোট ‘১২ দলীয় জোট’ও প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া বিএনপির সাথে যুগপৎ আন্দোলন করা গণতন্ত্র মঞ্চও পৃথক প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তবে তারা বিএনপির সাথে আসন সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন করবেÑ এটি প্রায় নিশ্চিত। অন্যদিকে, ড. কামাল হোসেনের গণফোরামও গত ১৫ নভেম্বর ১৩৩টি আসনে দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। বিএনপির মিত্র এলডিপি, ১২ দলীয় জোট ও গণফোরামও আসন সমঝোতার অপেক্ষায় আছে।

এসব দলের বাইরে বামপন্থি বিভিন্ন দলও নির্বাচনের প্রস্ততি নিচ্ছে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তফ্রন্টের আদলে বামপন্থিদের নতুন একটি জোট হতে যাচ্ছে। দেশের প্রধান প্রধান বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক জোট ও দলের সমন্বয়ে ‘কনভেনশনে’-এর মাধ্যমে চলতি নভেম্বরেই এর আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটবে। ছয়টি বাম দল নিয়ে গঠিত ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং শরীফ নূরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ বৃহত্তর এ জোট গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে।