আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এই লক্ষ্যে ভোটার নিবন্ধন অ্যাপ চালু করা হচ্ছে। সেখানে নিবন্ধন চূড়ান্ত করলেই ব্যালট পেপার চলে যাবে ভোটারদের কাছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে ব্যালট পৌঁছানোর পর, ভোট প্রদান শেষে সেটি রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে সর্বনিম্ন ১৫ দিন থেকে সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন বা ইসি।
এ কারণে বিদেশে যে ব্যালট পাঠানো হবে সেখানে থাকবে নিবন্ধিত সবগুলো রাজনৈতিক দল ও জাতীয় নির্বাচনের জন্য ইসির নির্ধারিত প্রতীক।
একই সাথে ‘না’ ভোট যুক্ত থাকবে ওই ব্যালটে। যদি কোনো আসনে একজন মাত্র প্রার্থী থাকেন, শুধুমাত্র সেই সব আসনের ভোটাররাই এই না ভোট দিতে পারবেন।
ইসির অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ জানিয়েছেন, শুধু ইসির অ্যাপে নিবন্ধিত প্রবাসী ভোটারদের ঠিকানায় ব্যালট পাঠানো হবে। প্রার্থীর প্রতীক চূড়ান্ত হওয়ার পরই অ্যাপ থেকে ভোটার তার আসনের প্রার্থী দেখে ভোট দিয়ে ব্যালট ফেরত পাঠাবেন বাংলাদেশে।
প্রবাসীদের কাছে ব্যালট পাঠানো থেকে শুরু ভোট প্রদান শেষে সেগুলো রিটার্নিং অফিসে পাঠানো পর্যন্ত পুরো দায়িত্ব থাকবে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের হাতে। নির্বাচন কমিশন বলছে, এক্ষেত্রে ভোটার প্রতি খরচ পড়বে মাত্র ৭০০ টাকা করে। খবর বিবিসি বাংলা।
বিদেশে বসে ভোট দিতে অ্যাপে নিবন্ধনের জন্য প্রত্যেক ভোটারেরই লাগবে একটি করে আন্তর্জাতিক সিমকার্ড।
একই সাথে অ্যাপে জিও লোকেশন চালু থাকার কারণে বাংলাদেশে বসে কোনোভাবেই অ্যাপটি ব্যবহার করা যাবে না বলে জানিয়েছে ইসির প্রবাসী ভোটার প্রকল্পের টিম লিডার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালীম আহমাদ খান। আগামী মঙ্গলবার এই অ্যাপ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
প্রবাসী ভোটার বাদেও এবার পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি চাকরিজীবী ও দেশের ৭১টি কারাগারে বন্দি ও কয়েদিরা। তাদের জন্যও আলাদা নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করবে ইসি।
প্রবাসী ভোটারদের অ্যাপে নিবন্ধন থেকে শুরু করে পুরো ভোটদান প্রক্রিয়া এবং করণীয় কী তা তুলে ধরা হচ্ছে এই প্রতিবেদনে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটের সুযোগ নিয়ে এর আগে বিভিন্ন সময় আলোচনা হলেও এবারই প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন প্রবাসীরা।এক্ষেত্রে, বিদেশে বসে ভোট দেওয়ার জন্য প্রথমেই নিবন্ধন করতে হবে।
নিবন্ধনের জন্য প্রবাসীকে গুগল প্লে স্টোর অথবা আইফোনের অ্যাপ স্টোর থেকে 'পোস্টাল ভোট বিডি' অ্যাপটি ডাউনলোড করে নিবন্ধন করতে হবে।
প্রবাসী ভোটার প্রকল্পের টিম লিডার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালীম আহমাদ খান জানান, প্রবাসী ভোটে ইসির সামনে দুটি অপশন ছিল ওয়েব ও মোবাইল অ্যাপ। মোবাইল অ্যাপে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, সে কারণে নির্বাচন কমিশন অ্যাপের মাধ্যমেই নিবন্ধন চালু করছে।
তিনি জানান, প্রবাসী ভোটাররা যার যার আন্তর্জাতিক মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে আগামী ১৮ই নভেম্বর থেকে চালু হওয়া 'পোস্টাল ভোট বিডি' অ্যাপে ভোটার নিবন্ধন করবেন।
এই অ্যাপটির বিশেষত্ব হচ্ছে অ্যাপটির জিও লোকেশন এনাবেল বা চালু থাকবে। যে কারণে বাংলাদেশ থেকে কোনোভাবেই এই অ্যাপটি চালু করা যাবে না।
আন্তর্জাতিক মোবাইল নম্বর প্রবেশ করানোর পর ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড বা ওটিপি আসবে। ওটিপি দিয়ে মোবাইল নম্বর নিশ্চিত করতে হবে।
এরপর জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডির ছবি তুলে আপলোড করতে হবে। পরবর্তীতে দিতে হবে ভোটারের ছবি।
সালীম আহমাদ খান জানান, রেজিস্ট্রেশনের সময় এনআইডির সাথে ওই ভোটারের ফেসিয়াল রিকগনিশনও যাচাই করতে হবে। অর্থাৎ এনআইডি সার্ভারে ওই ভোটারের যে ছবি আছে ফেস রিকগনিশনের সময় চেহারার সাথে মিনিমাম ৭০ শতাংশ মিল থাকতে হবে।
ক্যামেরার সামনে নে বায়ে মুখ ঘুরিয়ে ভেরিফিকেশনে পর চেহারার সাথে মিললে 'আপনি এখন নিবন্ধিত' লেখা প্রদর্শিত হবে অ্যাপে। এরপর পাসপোর্ট থাকলে সেটিরও ছবি দিতে হবে।
তিনি জানান—নিবন্ধনের জন্য পাসপোর্টের তথ্য চাওয়া হলেও, প্রবাসী বাংলাদেশি সবার কাছে পাসপোর্ট না থাকার কারণেই সেটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে না।
নির্বাচন কমিশন বলছে, যেহেতু নিবন্ধিত ভোটারের ঠিকানায় ব্যালট পাঠানো হবে সে কারণে বিদেশে যে ঠিকানায় তিনি থাকেন তিনি সেই ঠিকানাও সরবারহ করতে হবে অ্যাপে।
আগামী ১৮ই নভেম্বর অ্যাপটি চালু হওয়ার পর নিবন্ধনের জন্য ভোটাররা প্রায় এক মাসের মতো সময় পাবেন বলেও ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
প্রার্থী চূড়ান্তের আগেই যাবে ব্যালট?
প্রবাসের ঠিকানাসহ যখন একজন ভোটারের নিবন্ধন সম্পন্ন হবে, তিনি বাংলাদেশের যে আসনের ভোটার সেই আসন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে ভোটারের তথ্য চলে যাবে। সে অনুযায়ী হবে পৃথক ভোটার তালিকা।
ইসির ধারণা, প্রবাসী ভোটারদের নিবন্ধন শেষ হওয়ার চলমান থাকা অবস্থায়ই ঘোষণা হবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল। তখন প্রবাসী ভোটারদের অপেক্ষা করতে হবে ব্যালট পেপারের জন্য।
সালীম আহমাদ খান বলেন, ‘নিবন্ধনের সময় প্রবাসী ভোটার যে ঠিকানা দিয়েছিলেন সেই ঠিকানায় মার্কা ও প্রতীকসহ ব্যালটসহ একটি প্যাকেট পাঠানো হবে।’
তিনি জানান, ভিন্ন ভিন্ন আসনের ভোটার থাকলেও সব ভোটারের কাছে যাবে একই ব্যালট পেপার। যেখানে সবগুলো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত ১১৯টি প্রতীক থাকবে ব্যালটে।
প্রবাসী ভোটারের হাতে ব্যালট পেপার পৌঁছালেও প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন না কেউ।
রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো খাম পেলে ভোটার অ্যাপে প্রবেশ করবেন। এরপর নির্দেশিকা দেখে মোবাইল নম্বর নিশ্চিত করবেন। পরবর্তীতে খামের ওপর থাকা কিউআর কোড স্ক্যান করলেই ভোটার তার আসনের সব প্রার্থীর নাম দেখতে পাবেন।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব ও প্রবাসী ভোটার প্রকল্পের পরিচালক কে এম আলী নেওয়াজ বলেন, ‘মনোনয়নপত্র দাখিল, বাছাই ও প্রত্যাহারের পর যখন চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে তারপরই অ্যাপ থেকে স্ব স্ব আসনের প্রার্থী তালিকা জানতে পারবেন প্রবাসী ভোটাররা।’
ওই আসনে কোনো রাজনৈতিক দল বা তার পছন্দের প্রার্থীর প্রতীক ভোটার নিজেই দেখতে পারবেন অ্যাপে। সেখান থেকে প্রবাসী ভোটার ১১৯টি প্রতীকের মধ্যে তার পছন্দের প্রতীকের ব্যালটের পাশে টিক বা ক্রস চিহ্ন দিবেন।
প্রবাসী ভোটার প্রকল্পের টিম লিডার সালীম আহমাদ খান জানান, ‘পছন্দের প্রতীকে ভোট দেওয়ার পর ব্যালট রিটার্ন খামে ভরে তারপর কাছাকাছি পোস্ট অফিসে পাঠাবেন। আগে থেকেই ডাক মাসুল পে করা থাকবে। সে কারণে এটা চলে আসবে দেশে স্ব স্ব ঠিকানায়।’
নেওয়াজ বলছিলেন, যদি কোনো ভোটার ভোট দেওয়ার পর দেখলেন তিনি যে প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন সেই সেই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে, তখন ওই আসনের প্রবাসী ভোটও বাতিল হবে।
একই সাথে যদি ওই আসনে বাদ পড়া কোনো প্রার্থী যদি উচ্চ আদালতে আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পান, সেক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট আসনের প্রবাসী ভোট বাতিল বলে গণ্য হবে বলে জানান নেওয়াজ।
সময়মতো না পৌঁছালে ‘ভোট বাতিল’
ব্যালট পেপার যে খামে পাঠানো হবে তার সাথে থাকবে একটি ঘোষণাপত্র। ব্যালট পেপারে ভোট দেওয়ার পাশাপাশি ওই ঘোষণাপত্রেও স্বাক্ষর করতে হবে ভোটারকে।
সালীম আহমাদ খান বলেন, ‘যে খামে ব্যালট পেপার থাকবে সে খামের বাইরে আলাদা একটি খামে থাকবে ঘোষণাপত্র। ভোটার যে নিজে ভোট দিয়েছেন সেটি উনি ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করবেন এবং সেটিতে সাক্ষর করবেন।’
যদি কোনো ভোটার শুধু ভোট দিয়ে ঘোষণাপত্রে সাক্ষর ছাড়াই ব্যালট পেপার বাংলাদেশে পাঠান সেক্ষেত্রে ওই ভোটটি বাতিল ভোট হিসেবেই গণ্য করবে রিটার্নিং কর্মকর্তা।
নির্বাচন কমিশন বলছে, পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসী ভোটারদের ভোট আয়োজনে ভোটার প্রতি ইসির খরচ পড়বে ৭০০ টাকা।
এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এরই মধ্যে বাংলাদেশের ডাক বিভাগের সাথে চুক্তিও করেছে নির্বাচন কমিশন।
ডাক বিভাগের সাথে বৈঠকের পর নির্বাচন কমিশন ধারণা করছে, ব্যালট পাঠানো থেকে শুরু করে ফেরত আসা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে সর্বনিম্ন ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ দিন সময় লাগবে। সেই হিসাব করেই ব্যালট পাঠানো হবে ভোটারদের কাছে।
টিম লিডার সালীম আহমাদ খান জানান, ডাক বিভাগের সাথে নির্বাচন কমিশনের চুক্তি অনুযায়ী ব্যালট ট্র্যাকিং সিস্টেম যুক্ত থাকবে। কোন ব্যালট কোথায় আছে সেটি যেমন ভোটারও জানতে পারবে, তেমনি সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসও সেই তথ্য জানতে পারবে।
জাতীয় নির্বাচনের দিন বিকাল চারটার মধ্যে যে সব ব্যালট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পৌঁছাবে সেটিকে বৈধ ভোট ধরা হবে।
সালীম আহমাদ খান বলেন, নির্বাচনের তারিখ ভোটগ্রহণের সময় যদি শেষ হয় বিকাল চারটা, ওই সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে পারলেই ওটা বৈধ। এর পরে যদি সেটা এসে পৌঁছায় সেটিকে বাতিল ভোট হিসেবেই ধরা হবে।
এক্ষেত্রে সঠিক সময়ে ব্যালট এসে পৌঁছানো, কিংবা আগাম ব্যালট পাঠানোর পর নতুন কোনো প্রার্থী তালিকায় যুক্ত হওয়া কিংবা তালিকা থেকে বাদ পড়ার বিষয়টিকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে নির্বাচন কমিশন।