প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ৪ নভেম্বর পত্রিকাটির ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের ওই আয়োজনে প্রথম আলোর শুরুর কথা, এগিয়ে চলা, নানা সময়ের চ্যালেঞ্জসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন তিনি। উপস্থাপনায় ছিলেন সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী।
মতিউর রহমান চৌধুরী: সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলী, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল লিমিটেড আজকের সংবাদপত্রে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমাদের সঙ্গে রয়েছেন প্রথম আলো সম্পাদক জনাব মতিউর রহমান। ২৭ পেরিয়ে ২৮ বছরে পড়ল প্রথম আলো। অভিনন্দন আপনার টিমকে, নেপথ্যের কারিগর যাঁরা, তাঁদেরও। আর বিশেষভাবে আপনাকে অভিনন্দন, দেশের একমাত্র, মানে প্রথম শ্রেণির দৈনিক; শুধু সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকে পরিণত করেছেন সে জন্য। তো, শুনব আপনার সেদিনের কাহিনিগুলো কী? এবারের একটা লেখাও আছে ‘নতুন দিনে সত্যই সাহস’।
এই সত্যই সাহসটা কীভাবে দিল? এইটা আপনি মানে কী চিন্তা করে লিখলেন?
মতিউর রহমান: আপনাকে ধন্যবাদ আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।
২৭ বছর তো আমাদের কাগজ আমরা অতিক্রম করলাম, পূর্ণ করলাম। ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে যখন আমরা পত্রিকা শুরু করি, তখন আমরা কয়েকটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম। এ বিষয়ে আমাদের তৎকালীন চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান, তিনি এবং আমরা ঠিক করেছিলাম, এই পত্রিকাটাকে আমরা একটা দলনিরপেক্ষ ও স্বাধীন পত্রিকা হিসেবে দাঁড় করাতে চাই এবং আমরা সত্য কথা বলব। আমরা এই লক্ষ্য নিয়ে কাগজ শুরু করি। ২৭ বছর পর এসে আমরা বলতে পারি, আমরা যে লক্ষ্য নিয়ে কাগজটা শুরু করেছিলাম, সেখানে আমরা দৃঢ় ছিলাম। আমরা সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলাম এবং সত্য কথা বলার চেষ্টা করেছি।
আমরা এটা বলব না যে সব সময়, সব আমলে, সব সরকারের সময় আমরা সব সত্য কথা বলতে পেরেছি। বিশেষ করে বিগত ১৬ বছর স্বৈরাচারী সরকারের আমলে আমরা অনেক সত্য কথা বলতে পারিনি। যতটুকু বলার চেষ্টা করেছি, তাতে আমাদের যথেষ্ট চাপের মুখে, বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে। আমাদের প্রচারসংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার বহু চেষ্টা হয়েছে। আমাদের সরকারের অনেক বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ব্যক্তি খাতের প্রায় ৫০টি কোম্পানির বিজ্ঞাপনও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন যে প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, দেশের শত্রু। সরকার চেষ্টা করেছিল প্রথম আলোর মালিকানা কেড়ে নিতে, সরকার চেষ্টা করেছিল সম্পাদককে বদল করে দিতে। এসব অবস্থার মধ্যে গিয়ে আমরা টিকে আছি। কিন্তু শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এসব প্রশ্নের পেছনে শক্তি ওই সত্য। আমরা সত্য কথা বলার চেষ্টা করেছি; এবং সত্য বললে আপনি টিকবেন, আপনি চলতে পারবেন। আমাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে, কিছু এখনো রয়েছে। কোনো মামলায় কিন্তু আমাদের অপরাধী হিসেবে শাস্তি দিতে পারেনি; কারণ, আমাদের তথ্য, খবর, সংবাদ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। সে জন্যই বলি, আমরা সত্য কথা বলি। এখন আমরা বলছি, এখন প্রয়োজন ‘সত্যই সাহস’।
মতিউর রহমান চৌধুরী: কিন্তু সত্য বলা কঠিন।
মতিউর রহমান: কঠিন অবশ্যই। ভারতের দিকে তাকান, একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল, সেখানেও সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দিকে তাকান, এসব দেশেও কিন্তু সংবাদপত্র, টেলিভিশনগুলো চাপের মুখে, ভয়ের মুখে তাদের থাকতে হয়। আরও অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে। যেমন ভারতে এনডিটিভির মতো একটা টেলিভিশন চ্যানেলকে মালিকানা বদল করে আদানি গ্রুপ সেটা নিয়ে নিল। এ ধরনের সমস্যা তো আছেই। এখন আপনি বলতে পারেন যে সব সময় কি সব সত্য বলতে পারেন? আমি বলব যে সব সময় সব সত্য বলতে পারি নাই, বলা যায় নাই।
সত্য তথ্য প্রকাশ করেই আমাদের মানুষের মনে থাকতে হবে, তার কাছে আমাদের পৌঁছাতে হবে।মতিউর রহমান, সম্পাদক, প্রথম আলো
আপনি যদি বর্তমান সরকারের সময়ের কথা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমরা বলব, এখনো আমাদের কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু বিবেচনায় নিতে হয়। কারণ, আপনি জানেন যে প্রথম আলো এই সময়কালেও সরকারবহির্ভূত বিভিন্ন গোষ্ঠীর ব্যক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের অফিস আক্রান্ত হয়েছে, আক্রমণের চেষ্টা করা হয়েছে। এটাকে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার জন্য উসকানি দেওয়া হয়েছে। এসব তো চলেছে। অর্থাৎ কখনোই কোনো দেশেই সংবাদপত্র সব কথা সব সময় বলতে পেরেছে, এটা বলা যায় না। তবে আমাদের চেষ্টা থাকা উচিত, আমাদের চেষ্টা করতে হবে, যেন আমরা সত্য বলতে পারি।
মতিউর রহমান চৌধুরী: এই ফেক নিউজের যুগে সত্য বলা কি সহজ?
মতিউর রহমান: এটা আরেকটা বড় বিপদ, বিশ্বজুড়ে। এখন ছাপা পত্রিকা থেকে আমরা অনলাইন, ডিজিটালে, মোবাইলে, ভিডিওতে গেলাম। এখন বলা হচ্ছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ফার্স্ট। সবকিছুতে এআই ব্যবহার করে এটাকে নতুন এক জগতে আমাদের যেতে হবে। এসবের মধ্যে যে বিপদটা হয়েছে, তা হলো এত ধরনের ফেক নিউজ, অসত্য, অপপ্রচার, কুসংস্কার প্রচার হচ্ছে। এর কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যে, তা বিবেচনা করা আমাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে যায়। যে জন্য অফিসে আমরাও একজন ফ্যাক্ট চেকার নিয়োগ করেছি। অর্থাৎ প্রচারিত সংবাদগুলোর মধ্যে থেকে কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, তা দেখা। এই যুগে এসে সত্য-মিথ্যা বের করা খুব কঠিন। এ ব্যাপারে আমি, আপনি, আমাদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে।

মতিউর রহমান চৌধুরী: কিন্তু এ ক্ষেত্রে তো সাধারণ মানুষ অসহায়।
মতিউর রহমান: অসহায়। আমাদের এখন অতিরিক্ত দায়িত্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা, তাদের উদ্যোগী করা। আমাদের উচিত মিথ্যা তথ্যগুলো মানুষকে জানতে দেওয়া। আর এটার মধ্য দিয়ে আমরা যেটা বলছি বা লিখছি এটাই যে সত্য, আমাদের সেই জায়গায় পৌঁছাতে হবে। সত্য তথ্য দিয়ে আমরা যদি প্রমাণ করতে পারি, তাহলে ধীরে ধীরে মানুষ আমাদের কাগজ পড়বে, আপনার এবং অন্যদের সংবাদপত্র পাঠ করবে। এতে সংবাদপত্রের উপকার হবে। আমরা একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছি, এটা সত্য।
এই চ্যালেঞ্জের মুখেই আবার ভালো কাজের, সম্ভাবনাময় কাজের সুযোগ-সময় আসে। এটাই আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ। সত্য প্রকাশ করে আমরা প্রমাণ করব যে সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ছাপা পত্রিকা থেকে শুরু করে অনলাইন, ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও—সবকিছুর গুরুত্ব রয়েছে। সত্য তথ্য প্রকাশ করেই আমাদের মানুষের মনে থাকতে হবে, তার কাছে আমাদের পৌঁছাতে হবে।
মতিউর রহমান চৌধুরী: এ ক্ষেত্রে ছাপা কাগজের ভবিষ্যৎ কী?
মতিউর রহমান: দুই দশক ধরে এই আলোচনার মধ্যে আমরা আছি। আমরা যখন বিদেশে কোনো সম্মেলনে যাই, লেখা পড়ি বা শুনি—সর্বত্রই একটা কথা যে ছাপা কাগজ কমে যাচ্ছে। এটা অসত্য নয়। আবার এটাও সত্য কথা যে অনলাইনের পাঠকও কমে যাচ্ছে। এখন মানুষ কিছুটা বিরক্ত হয়ে, ফেক নিউজের চাপে পড়ে, বিভিন্ন অপপ্রচার বা বিজ্ঞাপনের কারণে অনলাইন থেকেও সরে আসছে। আবার অনেক দেশে দেখা যাচ্ছে ছাপা সংবাদপত্রের দিকে আগ্রহ ফিরে আসছে। আমাদের সে দিকটাও দেখতে হবে।
মতিউর রহমান চৌধুরী: এটা কি বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে?
মতিউর রহমান: বিশ্বাসযোগ্যতা একটা কারণ। অনলাইন তো দ্রুত তুলতে হয়, কয়েক মিনিটের মধ্যে। ছাপা সংবাদপত্র পোঁছায় এক দিন পরে। ফলে সব সংবাদ সঠিকভাবে উপস্থাপন করার জন্য হাতে সময় থাকে, সুযোগ পাওয়া যায়। এ সুযোগটা আমরা নিতে পারি। প্রিন্ট বা ছাপা পত্রিকা থেকে শুরু করার পর এল ডিজিটাল ফার্স্ট, তারপর আমরা দেখলাম মোবাইল ফার্স্ট, আর এখন ভিডিও ফার্স্ট। মানুষ সবকিছু দ্রুত জানতে চায়, শুনতে চায় এবং দেখতে চায়। এখন তো এআই যুক্ত করে নতুন করে মিডিয়া গড়ে তুলতে হবে।
মুশকিলটা হলো, আমাদের দেশে এত কিছুতে আমরা অভ্যস্ত না। আমরা অনেক কিছু জানি না; আমাদের সেই ধরনের মেধা বা শিক্ষিত বা মানুষ নাই, যাদের দিয়ে এ কাজগুলো দ্রুত করতে পারি। অথচ আমাদের সামনে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ চলে আসছে। এর মধ্যে আয় কমে যাচ্ছে, এটাও সত্য। মানে, প্রচারসংখ্যা কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনও কমে যাচ্ছে। কারণ, ছাপা কাগজে বিজ্ঞাপন, অনলাইনে বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন, ভিডিওতে বিজ্ঞাপন—বিজ্ঞাপন এভাবে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এই একটা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে আমরা পড়েছি, এটা ঠিক।
মতিউর রহমান চৌধুরী: শিল্পায়ন না হলে তো বিজ্ঞাপনও বাড়বে না।
মতিউর রহমান: আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় অর্থনীতির অবস্থা বেহাল, ভালো না। বিনিয়োগ নাই, উন্নয়ন নাই, অগ্রগতি নাই। এসব না হলে তো দেশের শিল্পকলকারখানার সম্প্রসারণ হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্য না বাড়লে যেমন উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সফলতা আসবে না, তেমনি আয়ও বাড়বে না। আর সেটা না হলে সংবাদপত্র সে ভাগটা পাবে না, যেটা আমাদের প্রাপ্য বা আমরা পেতে পারি।
আমাদের সামনে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ চলে আসছে। এর মধ্যে আয় কমে যাচ্ছে, এটাও সত্য। মানে, প্রচারসংখ্যা কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনও কমে যাচ্ছে। কারণ, ছাপা কাগজে বিজ্ঞাপন, অনলাইনে বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন, ভিডিওতে বিজ্ঞাপন—বিজ্ঞাপন এভাবে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে সরকারের বিজ্ঞাপনের যে দর বা রেট, এটা দিয়েও কিন্তু আমাদের কোনো সমস্যার সুরাহা হয় না। সেদিক থেকে সত্যিকারের অর্থে, সংবাদপত্রশিল্প, সেটা প্রিন্ট বলেন, ডিজিটাল বলেন, একটা সংকটের মধ্যে আছি। একটা চ্যালেঞ্জের মুখে আমরা পড়ে গেছি। এর থেকে আমাদের সম্মিলিতভাবে বের হতে হবে। সারা দুনিয়ায় এগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা হয়; কিন্তু কেউ খুব সন্তুষ্ট না। এখন পর্যন্ত যে সঠিক পথটি তাঁরা বের করতে পেরেছেন, তা নয়। এটা ঠিক যে নিউইয়র্ক টাইমস, লন্ডনের গার্ডিয়ান বা ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, তারা অনেক অগ্রগতি করেছে। তাদের সে শক্তি, ক্ষমতা ও অর্থ আছে। আমাদের তো সেটারও অভাব আছে। আমাদের তো এই জ্ঞান, এই চিন্তা, এই জগৎ সম্পর্কে ধারণাই নাই। আমরা শিখি, অগ্রসর হই, এর মধ্যেই আবার দেখা যায়, আরও পরিবর্তন ঘটে গেছে, নতুন বিষয় চলে আসছে। এর সঙ্গে মিলিয়ে চলতে পারাটা আরেকটা চ্যালেঞ্জ।
মতিউর রহমান চৌধুরী: কিন্তু এই যে পরিস্থিতি তৈরি হলো, এখান থেকে বের হতে হবে, আমাদের সামনে শিখতে হবে, জানতে হবে। কিন্তু সেই অবস্থা তো বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে নেই। এ জন্য তো শুধু পরিবেশ পরিস্থিতি না, আমরা যাঁরা সাংবাদিকতা করি, আমরা মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত, আমাদের কী সমস্যাটা? এটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মতিউর রহমান: আমরাও নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি। আপনি যদি আমাদের দেশের কথা বলেন, এখনো কিন্তু আমরা সেই আগের মতো করে আছি। এখানে চ্যালেঞ্জটা হলো, প্রথমে মাথার মধ্যে নিতে হবে, গ্রহণ করতে হবে যে আমরা পরিবর্তন চাই এবং পরিবর্তন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিগত দিক। প্রযুক্তির এই যুগে আমাদের এটা শিখতে হবে, জানতে হবে, তারপর সেটাকে প্রয়োগ করতে হবে। তারপর আয়ের পথ খুঁজতে হবে। আমাদের সঙ্গে যারা প্রতিযোগিতা করে, গুগল, ফেসবুক বা ইউটিউব বা অন্যরা, তারা নতুন নতুন পথ বের করে তাদের আয়টা বাড়িয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের আয়ের পথগুলোকে নানাভাবে আটকে রাখছে ও বাধা দিচ্ছে। সেগুলো কিন্তু একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের বাংলাদেশের সংবাদপত্রশিল্প, আমরা এসব জগৎ থেকে পিছিয়ে আছি। আমাদের মনমানসিকতা সে জায়গায় পৌঁছেনি; আমাদের টেকনিক্যাল নো হাউ, নলেজ, আন্ডারস্ট্যান্ডিং সে জায়গাতে নেই। এসব মিলিয়ে কিন্তু আমরা দুর্বল অবস্থানে আছি।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, কোনো সময়ই কোনো সরকার কোনো অবস্থাতেই সংবাদপত্রশিল্পকে তারা বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেনি। তার ফলে আমাদের যে প্রাপ্য, আমাদের যে পাওনা, সেটাও আমরা পাই না। আমরা বিজ্ঞাপন পাই না, রেটও কম। আবার সে বিল আমরা পাই না। এমনকি নতুন নতুনভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। যে সরকার যখন আসে, তাদের মিত্র ও তাদের বন্ধুদের তারা এই বিজ্ঞাপনে বড় অংশ বা সিংহভাগ দিয়ে দেয়। অন্যদের জন্য আর তেমন থাকে না। আমরা সেটা পাই না। অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে সেগুলো পেতে আমাদের বাধা দেওয়া হয়। একটা জটিল, কঠিন অবস্থার মধ্যে সংবাদপত্রশিল্প আছে। এখনো টিকে আছে, কিন্তু আগামীতে কী হবে, এটা বলা খুব মুশকিল। সে জন্যই হয়তো রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হলে, যদি বিনিয়োগ হয়; উন্নতি হয়, যদি অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা আসে, তাহলে কিছু আশা করতে পারি।
মতিউর রহমান চৌধুরী: মানে, আপনি বলছেন নির্বাচনের কথা।
মতিউর রহমান: বিষয়টা এসে গেছে।
মতিউর রহমান চৌধুরী: না, কথাটা বলেন প্লিজ। নির্বাচন তো সামনেই, ১০০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন হওয়ার কথা, যদি। এ নিয়ে তো সংশয় আছে। আপনি কি কোনো সংশয় দেখেন?
মতিউর রহমান: দেশের একটা পরিবর্তন ঘটল। মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা বা যে ঘটনা গত বছরের জুলাইয়ে ঘটল, সেটা একটা বিরাট গণ-অভ্যুত্থান। এর মাধ্যমে মানুষ যে রাজনৈতিক পরিবর্তন চাইল, সেটার একটাই পথ। আর তা হলো নির্বাচন। সে পথেই দেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। সে যাত্রাপথে অনেক প্রশ্ন, অনেক তর্ক, অনেক সংশয় রয়েছে। সর্বত্রই আলোচনা। যার সঙ্গে দেখা হয়, তিনিই বলেন, ‘ভাই, নির্বাচন কি হবে?’ এ বিষয়ে সত্যিকারের অর্থে বলব যে আমি খুব ভীত নই। সংশয়বাদীদের মতো এটা নিয়ে খুব ভাবিনি। আমি ধরে নিয়েছি যে নির্বাচন হবে, হতে হবে। এ ছাড়া আমাদের সামনে কোনো বিকল্প নাই।
আমরা নানা রাজনৈতিক দলের নানা বক্তব্য, বিবৃতি, কলহ, তর্ক, যুদ্ধ দেখি। কিন্তু বাস্তবে দেখেন, প্রায় সব দলই তার প্রার্থী ঘোষণা করে ফেলেছে। বেশ আগে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের ২৯৮ প্রার্থীর কথা ঘোষণা করে দিয়েছে। বিএনপি ২৩৭ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। আমরা শুনেছি, এনসিপি তাদের প্রার্থী ঘোষণা করবে। তাহলে দলগুলো তো নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে, দীর্ঘদিন প্রস্তুতি নিয়ে, প্রার্থিতা চূড়ান্ত করে দেশবাসীর সামনে জানিয়ে দিয়েছে।
বিএনপির প্রার্থীর নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমরা দেখলাম যে বেগম খালেদা জিয়াকে তিনটি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তারেক রহমানকে একটিতে। বেগম খালেদা জিয়ার তিনটি আসনে মনোনয়ন দেওয়ার পেছনে আমি দেখি, প্রথমত, দলের মধ্যে একটা উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি করা; অন্য দলগুলোর ওপর একটা চাপ তৈরি করা; আবার দেশের মধ্যে একটা নির্বাচনী আবহাওয়ার দিকে পরিবেশ তৈরি করা। সেদিক থেকে আমরা মনে করি, বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য দ্রুত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে কৌশলগতভাবে তারা একটা বড় পদক্ষেপ নিয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে যখন তর্ক ও সন্দেহ, আমরা তখন দেখলাম যে উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দিনের সময় দিয়েছে, যেন তারা একমত হয়ে বলে কোন পথে সরকার এগোবে। তা না হলে সরকার নিজেদের মতো করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ বলেন, গণভোট বলেন বা সংবিধান সংস্কার—বিষয়গুলো নিয়ে পদক্ষেপ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে।
মতিউর রহমান চৌধুরী: আট মাস ধরে তো আলোচনা হলো। এখন আবার সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ছেড়ে দিয়েছে এবং সাত দিনের মধ্যে, এটা কি সম্ভব?
মতিউর রহমান: সাত দিনের মধ্যে আলোচনা, এটা শেষ করা সম্ভব না। যদি এটা হয়ে যায়, আমি খুব অবাক হব। কারণ, যেটা আট মাস ধরে আলোচনার মধ্য দিয়ে যেখানে আটকে গেছে, সেখানে সাত দিনের মধ্যে আলোচনা করে সমাধান করতে পারবেন, আমার কাছে এটা মনে হয় না। আর বিগত ইতিহাস কিন্তু বলে না যে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা বসে কোনো দিন কোনো সমস্যার সমাধান তারা করতে পেরেছে। অতীতে আমরা এ ধরনের উদ্যোগ নানা সময় দেখেছি এবং প্রত্যেকটি ব্যর্থ হয়েছে। গণভোটের ব্যাপারে কিন্তু আমি খুব বড় পার্থক্য দেখি না। আটটি দলসহ জামায়াতে ইসলামী বলছে, নভেম্বরের মধ্যেই তারা গণভোটের তারিখ চায়। এখন তো কেউ বলবে না যে নভেম্বরের মধ্যে একটা গণভোট করা সম্ভব। এটা অবাস্তব।
আমি মনে করি না এ সময় এসে কোনো দলের পক্ষে নির্বাচন বর্জন করার মতো পদক্ষেপ কেউ নিতে পারবে। নিলে সেটা একটা দলের জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে। বহুমুখী ক্ষতির সম্মুখীন হবে দলটি।মতিউর রহমান, সম্পাদক, প্রথম আলো
আবার বিএনপি বলেছে একই দিনে যদি গণভোট এবং সাধারণ নির্বাচন হয়, তাহলে তারা সম্মত হবে। এনসিপিও কিন্তু মোটামুটি এ পথে একমত আছে। আমি তো খুব বড় পার্থক্য দেখি না। নভেম্বরের মধ্যে গণভোট নিয়ে জামায়াতে ইসলামী যে কথাগুলো বলছে, এটা তো হয়তো কেউ মানবে কি না আমি জানি না, কিন্তু সময় তো তাদের হাতে নাই। শেষ পর্যন্ত আমি ঘুরেফিরে দেখি, গত সপ্তাহে উপদেষ্টা পরিষদের যে আলোচনা হয়েছে, সেখানে অধিকাংশের মত ছিল একই দিনে গণভোট এবং সাধারণ নির্বাচন করার। সেদিকেই হয়তো সবাইকে একমত হতে হবে। তো আমরা সাত দিন পরে যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতগুলো পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করে, তখন তো রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে সেগুলো না মেনে, অন্য কোনো বিকল্প পথ থাকবে না।
আমি মনে করি না এ সময় এসে কোনো দলের পক্ষে নির্বাচন বর্জন করার মতো পদক্ষেপ কেউ নিতে পারবে। নিলে সেটা একটা দলের জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে। বহুমুখী ক্ষতির সম্মুখীন হবে দলটি।
মতিউর রহমান চৌধুরী: অন্তর্বর্তী সরকারকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মতিউর রহমান: শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের আগে পর্যন্ত বা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে কেউ খুব ভেবেছে বলে আমার জানা নাই। দাবি ছিল একটি, সরকারের পতন। সরকারের পতন হয়ে যাওয়ার পরেই কিন্তু মূলত এই তৎপরতা শুরু হয়। আর যাঁরা তৎপরতা করেছেন, যাঁরা অংশীদার ছিলেন, বিশেষ করে আমি ছাত্রনেতৃত্বের কথা বলি, তাদের কিন্তু সত্যিকার অর্থে একটা জোরালো ও ভালো অন্তর্বর্তীকালে সরকার গঠন করার মতো বাস্তব অভিজ্ঞতা বা ব্যক্তিগুলোকে চেনা-জানার মতো অবস্থা ছিল না। তাঁদের বেশ কয়েকজন পরামর্শক বা বন্ধুদের সহায়তা ও সহযোগিতা নিয়ে, কথা বলে, আলোচনা করে, ব্যক্তিগুলোকে নির্বাচন করেছেন। সকল সরকারের সময় আমরা দেখি, এটা সব সময়, খুব সফল তাঁরা হন না।
আপনার মনে আছে, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হওয়ার পর আমরাও বলেছিলাম যে ডক্টর ফখরুদ্দীনকে শুভেচ্ছা, তবে উপদেষ্টা পরিষদ আমাদের কাছে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হয়নি। এবারও কিন্তু এ রকম একটা প্রশ্ন উঠেছিল। সফল হবেন কি না, এ ধরনের প্রশ্ন ছিল। এ প্রশ্ন এখনো রয়েছে এবং অনেকেই সফল হয়েছেন, অনেকে হয়তো হতে পারেননি। এটা খুবই বাস্তব। সবাই একই রকম হয় না। তবে এই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের আরও অনেক কিছু চাহিদা ও দাবি ছিল। যেগুলো তাঁরা পূরণ করতে পারেননি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বা রক্ষাকারী বাহিনীকে যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী করা, তাদের ব্যবহার করা, কাজে লাগানো বা মব সন্ত্রাসকে বন্ধ করা বা আরও অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রে কতগুলো অধোগতিকে রোধ করা, নতুন পথের সন্ধান দেওয়া, নতুন উদ্যোগ নেওয়া, এই কাজগুলোর ক্ষেত্রে কিন্তু তাঁরা তেমন সফল হননি।
আমরা নানা রাজনৈতিক দলের নানা বক্তব্য, বিবৃতি, কলহ, তর্ক, যুদ্ধ দেখি। কিন্তু বাস্তবে দেখেন, প্রায় সব দলই তার প্রার্থী ঘোষণা করে ফেলেছে।
তবে সরকার একটি প্রধান কাজ হাতে নিয়েছিল, সংবিধান সংস্কার। বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া। সেসব ক্ষেত্রে খুব অগ্রগতি হয়নি। সবচেয়ে দৃশ্যমান যে কাজটা তারা করেছে, সেটা হচ্ছে ঐকমত্য কমিশন গঠন করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রায় আট মাস ধরে, ৩৩টা দল, পরে ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেছে। তার মধ্যে পাঁচ, সাত, আটটি দল নিয়ে নানাভাবে, নানা দিক থেকে হয়তো মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আছে। অন্যরা তেমন কোনো শক্তি, সমর্থন, বা দাবি আদায়ের মতো জায়গায় ছিল না।
তারপরও কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে সাত-আট মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রকাশ্যে আলোচনা, যেটা টিভিতে দেখা যায়, রেডিওতে শোনা যায়, এটা কিন্তু একটা নতুন অভিজ্ঞতা। সেদিক থেকে বলব যে ধৈর্য ধরে এত দিন আলোচনা চালিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সংস্কার প্রস্তাবে একমত হওয়াকে আমি অগ্রগতি বলতে চাই। তার মধ্যে ৪৮টি ছিল সংবিধান সংশোধন সংস্কারবিষয়ক। মনে হচ্ছে যে এগুলোকে নিয়ে একটু সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছে সরকার, সংকট তৈরি হয়ে গেছে। তবে সামনেও আমাদের আরও সুযোগ, সম্ভাবনার জায়গা আছে; আলোচনার জায়গা আছে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁদের হাতে আরও সময় আছে।

মতিউর রহমান চৌধুরী: অন্য প্রসঙ্গ। আর সেটা হচ্ছে যে একসময় আপনি নাগরিক সমাজের ব্যাপারে খুবই সোচ্চার ছিলেন। বিশেষ করে আপনার পত্রিকা প্রথম আলো সোচ্চার ছিল। ইদানীং আমি লক্ষ করছি যে আপনি এই ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু কেন?
মতিউর রহমান: আমাদের দেখা পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল নাগরিক সমাজের জন্য একটা উজ্জ্বল সময়। নাগরিক সমাজ বলতে লেখক, শিল্পী, কবি, ছাত্রসমাজ, আইনজীবী, অন্যান্য পেশাজীবী মানুষ, ব্যাপক উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছে। যদি আমরা ’৫২, ’৬২, ’৬৯, ’৭০, ’৭১ সালকে দেখি, পরবর্তী ’৯০-এ এসে আমরা সেটা আবার দেখি। সেই পরিবেশে মানুষগুলো এককাট্টা হয়েছিলেন সত্যিকার নিঃস্বার্থভাবে, দেশের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য। ওই প্রজন্মের মানুষগুলো আজ ধীরে ধীরে চলে গেছেন, তাঁরা নাই আর।
এর মধ্য দিয়ে, স্বাধীনতার পর থেকে আপনি মুক্তিযুদ্ধ বলেন, জাতীয়তাবাদ বলেন, অসাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নে বলেন, ধর্মের প্রশ্নে বলেন, নানা বিষয়ে, আমাদের সমাজের মধ্যে, ছোট-বড়, নানা রকম তর্ক এসেছে। এসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, বিরোধ হয়েছে, বিভেদ হয়েছে। এগুলোকে আমরা ধামাচাপা দিয়েছি। এগুলো নিয়ে আমরা ভালো আলোচনা, তর্কবিতর্ক করিনি এবং সর্বশেষ আমরা দেখলাম যে বিগত ১৬ বছরের যে আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনার সরকার ছিল, তারা এই বিষয়গুলোতে অন্যায়ভাবে এগুলোকে অপব্যবহার (অ্যাবিউজ) করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে প্রচার করতে গিয়ে, প্রমাণ করতে গিয়ে যে শেখ মুজিবুর রহমান একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বের ভূমিকাকে, যা আমরা অস্বীকার করতে পারি না, তাঁর অবস্থানকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে সংকীর্ণভাবে, গোষ্ঠীর স্বার্থে, দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে বিষয়গুলো সম্পর্কে মানুষের মধ্যে একটা অনীহা, একটা আপত্তি, একটা বিরোধিতা চলে এসেছে। এটাকে আমরা অস্বীকার করতে পারব না যে অনেক বাড়াবাড়ি হয়েছে।
আগামী দিনেও সংকটে থাকব, যদি আমরা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আমাদের সামাজিক নেতৃত্ব, আমাদের নাগরিক সমাজ যদি সত্যিকার অর্থে দেশের মধ্যে একটা বৃহত্তর ঐক্য ও সমঝোতার পরিবেশ তৈরি না করতে পারে।
এর ফলে এ বিষয়গুলোতে মানুষের মধ্যে বিভক্তি এসেছে, সন্দেহ, অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। এগুলো নিয়ে এখন নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। সেটাও একটা ভালো, যে আলোচনা আগে হতে পারেনি, হয়নি, বাধা দেওয়া হয়েছে, বিরোধ তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আজকে নতুন করে আলোচনার সুযোগ হয়েছে। আমাদের এ আলোচনায় যুক্ত হতে হবে, নতুন করে ভাবতে হবে।
আলোচনার মধ্য দিয়ে যেখানে যতটুকু পারা যায়, প্রত্যেকটা বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা ঐকমত্য তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে। না হলে রাজনৈতিকভাবে, আদর্শগতভাবে, সামাজিকভাবে এবং আরও অন্যান্য দিক থেকে যে বৈষম্য, যে বিরোধ, যে সংঘাত তৈরি হয়েছে, তাতে একটা দেশ বা রাষ্ট্র চলতে পারে না। আমরা কিন্তু এ রকম একটা সংকটের মধ্যে আছি। আগামী দিনেও সংকটে থাকব, যদি আমরা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আমাদের সামাজিক নেতৃত্ব, আমাদের নাগরিক সমাজ যদি সত্যিকার অর্থে দেশের মধ্যে একটা বৃহত্তর ঐক্য ও সমঝোতার পরিবেশ তৈরি না করতে পারে, আমরা না করতে পারি। সংবাদপত্রের ভূমিকাও সেখানে অনেক আছে। তাহলে কিন্তু এর থেকে আমরা বের হতে পারব না।
মতিউর রহমান চৌধুরী: আমরা প্রায় শেষ দিকে, আগামীতে কেমন নেতৃত্ব চান?
মতিউর রহমান: ন্যূনতমভাবে রাজনৈতিকভাবে, গণতান্ত্রিকভাবে, সহিষ্ণু নেতৃত্ব হবে, যাঁরা মানুষের, ব্যক্তির, প্রতিষ্ঠানের, সংবাদপত্রের সমালোচনা শুনবেন। তাঁরা সংবাদপত্রকে একটা স্বাধীন জায়গায় অবস্থান করতে দেবেন, যেন আমরা সত্যিকার অর্থেই সত্য কথা বলতে পারি, যে কথাগুলো তাঁদের জন্য আরও বেশি করে প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ভিত্তিতে একটা সমঝোতা এবং বৃহত্তর নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নিয়ে একটা সমঝোতার ক্ষেত্র তৈরি করবেন। আর দুর্নীতি প্রতিরোধ করা। সামাজিক অসন্তোষ এবং শ্রেণি, পেশা ও মানুষের মধ্যে বিরোধ, বৈষম্য নির্মূল করা। নির্মূল করাটা আমি বেশি বলে ফেলি, সেটাকে কমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা।
নতুন সরকার, যাঁরা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাঁরা সকলকে নিয়ে একটা ঐকমত্য ও সমঝোতার ভিত্তিতে চলবেন—এটাই আমরা আশা করি।মতিউর রহমান, সম্পাদক, প্রথম আলো
সমাজে নারীর সমমর্যাদার বিষয়টাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং শ্রমিক, কৃষক, যাঁরা দেশকে টিকিয়ে রেখেছেন, সামনে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের গুরুত্ব দেওয়া। অথচ সরকারের অবস্থানটা দেখেন, শিক্ষার ব্যাপারে দেখেন, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দেখেন, কত অবহেলা, কী দুর্গতি। এই দিকগুলোতেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে একটা সমঝোতামূলক জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। অনেকে মাঝে মাঝে বলে ফেলেছেন যে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশনের দিকে যাওয়া। এটা খুব কঠিন কাজ। দক্ষিণ আফ্রিকাও এটাকে নিয়ে তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারেনি। আমরা এই বিরোধপূর্ণ রাষ্ট্রে, সংঘাতপূর্ণ রাষ্ট্রে যেখানে ন্যূনতম সমঝোতা আমাদের মধ্যে নাই, সেখানে এ ধরনের একটা কাজ আমরা করতে পারব, সেটা আমাদের এখন মনে হয় না।
তবে আমাদের ধীরে ধীরে হলেও একটা জায়গায় যেতে হবে, যেখানে অন্ততপক্ষে আমরা রাষ্ট্র হিসেবে, একটা সমাজ হিসেবে, একটা জায়গায় আমরা দাঁড়াতে পারি। আমাদের রাষ্ট্রের একটা কল্যাণমুখী, একটা গণতান্ত্রিক সমাজ, রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য কতগুলো বিষয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ একটা প্রশ্ন। এখানে একটা সমঝোতায় আমাদের আসতে হবে, মানতেই হবে। জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন, প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ, এটা আমাদের দেশের প্রয়োজন। কীভাবে একে ব্যবহার করা যাবে, কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, এ বিষয়গুলোকে আমাদের ভাবতে হবে।
আমাদের অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক একটা সমাজ তৈরি করার জন্য অব্যাহত চেষ্টা করতে হবে। ধর্মের বিষয়ে সহনশীলতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এটাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আমাদের বিবেচনা করতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে। আবার আমাদের ন্যায্য ভাগ, হিস্যা যেন আমরা পাই, সেদিকে নজর রাখতে হবে। অনেক দীর্ঘ তালিকা হয়ে যায়। তবে ন্যূনতম পক্ষে নতুন সরকার, যাঁরা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাঁরা সকলকে নিয়ে একটা ঐকমত্য ও সমঝোতার ভিত্তিতে চলবেন—এটাই আমরা আশা করি। না হলে আবার যদি বিরোধ, বিভেদ, সংঘাত হয়, আবার যদি কয়েক বছর পর মানুষের মধ্যে, অসন্তোষ, বিক্ষোভ এবং জনবিদ্রোহ তৈরি হয়, তাহলে এই ধরনের সংকট, সংঘাত বোধ হয় আমরা বেশি দিন সহ্য করতে পারব না। আমাদের রাষ্ট্র, সেটা নিতে পারবে না।
মতিউর রহমান চৌধুরী: মতি ভাই, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
মতিউর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
[ঈষৎ সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত]
[৪ নভেম্বর চ্যানেল আইতে প্রচারিত ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানের আলোচনা থেকে লেখাটি তৈরি]
