Image description

দেশের কোথাও আর নিরাপত্তা নেই- এ কথা বারবার বলছেন সাধারণ মানুষ। রাস্তায় টার্গেট করে গুলি, ঘরে ঢুকে কুপিয়ে হত্যাÑ সবই ঘটছে প্রকাশ্যে। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর ব্যক্তিগত বিরোধে প্রতিদিনই ঝরছে রক্ত। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসেই খুন হয়েছেন ২ হাজার ৯১১ জন। রাজনৈতিক সহিংসতায় আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৮৩৫ জন এবং নিহত ৯০ জন। খুনের ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ‘ডেভিল হান্ট’ বা ‘চিরুনি অভিযান’Ñ কোনোটাই কাজে আসছে না। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, খুনের নৃশংসতা মানুষের মধ্যে ভয় ছড়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়ানো হচ্ছে। ঢাকায় ২৪ টুকরো লাশ উদ্ধারের মতো ঘটনা মানুষের মানসিক নিরাপত্তাকে ধাক্কা দিচ্ছে। তারা আরও জানানÑ জুলাই অভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া অস্ত্রের বড় অংশ উদ্ধার না হওয়া, অপরাধী গ্রেপ্তারের পর নির্বিচারে ছাড়া পাওয়া এবং পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাÑ এসব কারণে পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের খুনের ঘটনা ঘটে ৩৫৩৯টি, ২০২১ সালে ৩২১৪টি, ২০২২ সালে ৩১২৬টি, ২০২৩ সালে ৩০২৩টি, ২০২৪ সালের ৪১১৪টি। তবে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের গেজেটভুক্ত শহীদের সংখ্যা ৮৬৪ জনকে বাদ দিলে সাধারণ নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২৫০ জনে। আর চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে খুন হয়েছে ২৯১১ জন। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে ২৯৭ জন খুন হয়েছেন। অক্টোবর মাসে খুনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৯ জনে। এই হিসাবে প্রতি আড়াই ঘণ্টায় খুন হচ্ছে একজন করে মানুষ।

সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টির করতে নৃশংস ধরনের অপরাধ ঘটানো হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর মব সন্ত্রাস থেকে শুরু করে অধিকাংশ অপরাধের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দোদুল্যমান অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিচ্ছে। কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় হত্যা ও ঘরবাড়ি দখলসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বাড়ছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে এর প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনে পড়বে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের

পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) ৩৫১টি রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতায় আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৮৩৫ জন, নিহত ৯০ জন। এর মধ্যে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষে ৪২৭ জন আহত ও ৮ জন নিহত হয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষে আহত ৩৩৫ জন, নিহত ৩। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে ৫৬ জন আহত ও ৪ জন নিহত হয়েছেন। বিএনপির সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষে সর্বোচ্চ ১৯২৩ জন আহত ও ৩৩ জন নিহত হয়েছেন।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি মাঠ পুলিশের একটি অংশ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে না। রাজনৈতিক সরকারের অপেক্ষায় কোনোমতে নিরাপদে সময় পার করার চেষ্টা করছেন। ফলে মাঠ পুলিশে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে অপরাধীরা।

পুরানো ঢাকার লক্ষীবাজারের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন বলেন, ঘরে কিংবা বাইরে আক্রান্ত হলে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা তারা পাবেন, এই ভরসা পাচ্ছেন না। সামাজিকভাবে প্রতিরোধেও কেউ এগিয়ে আসছে না। কয়েক দিন আগেও তার বাসা থেকে কয়েক শ মিটার দূরে প্রকাশ্যে মানুষের সামনে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হত্যার সেই নৃশংস দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এসব দেখে ভয় ও আতংক আরও বাড়ছে।

পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের মনোবল ফেরানো, কার্যকর অপরাধ দমন কৌশল প্রণয়ন এবং প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। সরকারকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে কার্যকর, সাহসী ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, রাজনৈতিক সরকার না থাকায় পুলিশের অনেক কর্মকর্তাই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) তালেবুর রহমান বলেন, আমরা সব ধরণের অপরাধ প্রতিরোধে কাজ করছি। তার পরও বিচ্ছিন্ন অপরাধ ঘটনা ঘটছে। এখন হত্যাকাণ্ডসহ অপরাধের ঘটনার ঘটার পর আমরা অপরাধীদের আওতায় আনতে পারছি কিনা এটা হলো মুখ্য বিষয়। পুরানো ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের পর আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আসামি গ্রেপ্তার করেছি।

হত্যাকাণ্ডে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে : রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে সরোয়ার হোসেন বাবলা নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যার রেশ না কাটতেই সোমবার সকালে পুরানো ঢাকার রাস্তায় ফিল্মি স্টাইলে খুন করা হয় তারিক সাইফ মামুনকে। প্রকাশ্য দিবালোকের হত্যাকাণ্ডের আন্ডারওয়ার্ল্ডের সংযোগ দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় আবদুল মান্নান (৪০) নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত মান্নান জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। তাকে শটগান দিয়ে বুকে ও কপালের বাম পাশে তিনটি গুলি করা হয়েছে। চট্টগ্রামে একই রাতে খুন হয়েছেন মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানি আকাশ ঘোষ ও ইলেকট্রিশিয়ান আব্দুল্লাহ আল মাসুদ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লুটের পর উদ্ধার না হওয়া হাজারের বেশি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও চোরাই পথে আসা অস্ত্র এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যবহৃত হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে এবং পরবর্তী সময়ে অনেক অস্ত্র-গুলি সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে। পুলিশের লুট হওয়া ১ হাজার ৩৪২টি অস্ত্র এখনও উদ্ধার করা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবারিদের সংঘর্ষে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে। গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর ও জেলায় খুন হয়েছেন ৩৫ জন। এর মধ্যে গুলিতে খুন ২২ জন। হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে অন্তত ১৫টি ঘটেছে রাজনৈতিক বিরোধের কারণে। এ ছাড়া গত ১৫ মাসে খুলনায় ৪১ জন হত্যার শিকার হন। এর মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে ১৫টিতে।

ঘরে ঢুকে হত্যাকাণ্ড : ঘরে ঢুকে খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আবদুর রহমানের ভাড়া বাসায় ঢুকে ছেলে তাওসিফ রহমান সুমনকে ছুরিকাঘাত করে হত্যার ঘটনা ঘটে। হামলায় বিচারকের স্ত্রী আবদুর রহমানের স্ত্রী তাসমিন নাহার গুরুতর আহত হয়েছেন। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে ইমন নামে এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করেন। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে তিনটার দিকে রাজধানীর বাড্ডার বাসায় ঢুকে মামুন শিকদার নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গত রবিবার সিলেটের কানাইঘাটে আবদুল হান্নানের (৫৫) ঘরে ঢুকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত বুধবার ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায় ঘরে ঢুকে এক পরিবারের দুই সদস্যকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহতরা হলেনÑ রতন মিয়া (৩৩) ও তার সাত বছর বয়সী মেয়ে নুরিয়া আক্তার। পাওনা টাকা নিতে রংপুর থেকে ঢাকায় আসা কাঁচামাল ব্যবসায়ী আশরাফুল হককে হত্যার পর ২৬ টুকরো করা হয়েছে। পরিবারের দাবি, আর্থিক লেনদেনের কারণে আশরাফুলকে হত্যা করেছে তার বন্ধু জরেজ।