Image description
এলাহী নেওয়াজ খান
 

আমরা যেন একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত অতিক্রম করছি; দিগন্তে ফুটে উঠেছে একটি আলোর রেখা। অতিকথন নয়, বাস্তবায়নেরই অঙ্গীকার যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সেটাই মনে হলো ড. প্রফেসর ইউনূসের ভাষণ শুনতে শুনতে। মনে হচ্ছিল অতীতের কায়েমি স্বার্থের নিগড়ে বাঁধা পুরোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন একটি বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার তিনি ঘোষণা করছেন। সেইসঙ্গে তিনি দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিলেন, যত মহল থেকে যত কুৎসা রটনা করা হোক না কেন তিনি নির্ধারিত সময়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কেবল তার ১৫ মাসের শাসনের সাফল্যের কথাই বলেননি, তিনি নতুন বাংলাদেশের একটা রূপরেখা ঘোষণা দিয়েছেন, যা পরিবার ও গোষ্ঠীতন্ত্রের অবসানের ইঙ্গিত বহন করছে। মনে হলো তিনি তার ভাষণে গত ১৫ মাস ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার ঐক্য ও অনৈক্যের মধ্যে একটা চমৎকার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছেন। বলা যায়, তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয়ের বার্তা প্রদান করেছেন।

যেমন জুলাই সনদের ওপর গণভোটের কথাই ধরা যাক। এই ইস্যুতে বিএনপির দাবি ছিল জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোটের ব্যবস্থা করা। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও আরো দু-একটি দল চাচ্ছিল জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট করা হোক। প্রফেসর ইউনূস আম্পায়ারের মতো জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোটের ফয়সালা দিয়ে দিয়েছেন। এরপর এই ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো যদি পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে, কিংবা ঠেলাঠেলি অব্যাহত রাখে, তাহলে সেটা হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। বরং এ ধরনের দ্বন্দ্ব কার্যত রাজনৈতিক দলগুলোর চরম কাঙ্ক্ষিত জাতীয় নির্বাচনকেই আরো কঠিন করে তুলবে।

এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহল গণভোট অনুষ্ঠানের পদ্ধতিগত জটিলতা নিয়ে অনেক দিন ধরে নানা কথা বলে আসছিল। এতগুলো প্রস্তাবনায় ভোটাররা কোনটায় ‘হ্যাঁ’ বলবে, কিংবা ‘না’ বলবে, তা নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন অনেক দিন ধরে উত্থাপিত হয়ে আসছিল। তাই প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে ভোটাররা কীসে ‘হ্যাঁ’ বলবেন বা ‘না’ বলবেন, সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জুলাই সনদের ৩০টি অনুচ্ছেদকে চারটি বিষয়ে সন্নিবেশিত করে একটি প্রশ্ন তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং এ ব্যাপারেও আর কোনো জটিলতা থাকার কথা নয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, অন্য অনেক আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশে একটি ভারসাম্যপূর্ণ শাসনব্যবস্থা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একটি শাসন পদ্ধতির কথা জুলাই সনদে উল্লেখ থাকলেও বিশেষ করে উচ্চকক্ষ কত কত সদস্যবিশিষ্ট হবে, তার উল্লেখ ছিল না। কিন্তু প্রফেসর ইউনূস তার ভাষণে বলেছেন, উচ্চকক্ষ হবে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট। আর সনদটি গণভোটে অনুমোদিত হলে সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীলতা লাভ করবে; অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনে যে দল যত ভোট পাবে, সে অনুসারে উচ্চকক্ষে ভাগ পাবে। সুতরাং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীলতার ব্যাপারেও এই ভাষণে ঠিক হয়ে গেছে। ফলে এ বিষয় নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনেক দিন ধরে যে টানাপোড়েন ও সিদ্ধান্তহীনতা চলে আসছিল, তারও অবসান ঘটেছে। কারণ প্রফেসর ইউনূস একটা সমাধান দিয়ে দিয়েছেন। তিনি এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বের একটা অবসান ঘটিয়েছেন।

তবে এ ব্যাপারে যেসব রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি করেছিলেন, তারা এই ভাষণে কিছুটা হতাশ হলেও প্রফেসর ইউনূস একটি সমাধানের পথ তো বাতিয়ে দিয়েছেন। বলা যায়, তিনি খুব সুচিন্তিতভাবে বলটা রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে ঠেলে দিয়েছেন। এখন রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে খেলবে বা বিষয়গুলোকে গ্রহণ করবে, তার ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনের নতুন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তবে বৃহস্পতিবার রাতেই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি স্বাগত জানিয়েছে।

উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীলতা নিশ্চিত হলে একটি রাজনৈতিক দল শতকরা পাঁচ ভাগ কিংবা তার চেয়েও কম ভোট পেলেও উচ্চকক্ষে প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ পাবে। এর ফলে আমরা বারবার যে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলছি, তা নিশ্চিত হবে। এই পদ্ধতিতে সংসদে কোনো বিল পাস হলে তা চূড়ান্ত আইনে রূপ দিতে উচ্চকক্ষের অনুমতি লাগবে। এর ফলে শাসনব্যবস্থায় একটা ভারসাম্য তৈরি হবে।

এখানে উল্লেখ করতে হয়, আমরা ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কার্যত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির মতোই ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। প্রধানমন্ত্রী সংসদের কাছে জবাবদিহি করবেন বলে সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও তা কখনো কার্যকর হয়নি। সুতরাং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থা হলে এবং জুলাই সনদে যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবায়িত হলে জবাবদিহিতামূলক একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জনগণ উপভোগ করতে পারবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ও জেনারেল এরশাদের সময়কালে অনেকগুলো সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা কখনো প্রকাশ পায়নি। ফলে‌ বাস্তবায়নেরও প্রশ্ন ওঠেনি। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো মিলিতভাবে যেসব সংস্কারে ঐকমত্য পোষণ করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে অবশ্যই বাংলাদেশ নতুন এক সম্ভাবনাময় যুগে প্রবেশ করবে। প্রফেসর ইউনূসের ভাষণে সেটাই ফুটে উঠেছে।

আরেকটি বিষয় আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে, সেটা হচ্ছে যে, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস শুরু থেকে এ পর্যন্ত জাতির উদ্দেশে যতগুলো ভাষণ দিয়েছেন, সবগুলোতেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তার অঙ্গীকারের কথা বারবার ব্যক্ত করে এসেছেন। এ ব্যাপারে তার মধ্যে কখনোই কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা যায়নি। বৃহস্পতিবারের ভাষণেও তিনি আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা খুব জোরের সঙ্গেই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অথচ নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে ক্রমাগতভাবে সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ থেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে যায়, প্রফেসর ইউনূস আগাগোড়াই তার ভাষণে তার চিন্তা ও কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন।

অন্যদিকে প্রফেসর ইউনূস ১৩ নভেম্বর এমন একটা দিনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন, যে দিনটিতে নিষ্ঠুর শাসক শেখ হাসিনার মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার দিন ছিল। শুধু তা-ই নয়, এই দিনটিতে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ চূড়ান্ত সন্ত্রাস সৃষ্টি করার ঘোষণা দিয়েছিল। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রফেসর ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে শুধু সাহসিকতারই পরিচয় দেননি, বরং তিনি শেখ হাসিনাসহ গণহত্যাকারীদের বিচারের ব্যাপারে তার দৃঢ়তার কথা জোরালোভাবে উচ্চারণ করেছেন।

পরিশেষে এটা বলা যায়, শেখ হাসিনার বিচার ঠেকাতে এবং নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যেভাবে চোরাগোপ্তা বোমা হামলাসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছে, তাতে হয়তো জনগণকে আতঙ্কিত করা গেলেও রাজনৈতিক সুবিধা লাভ সুদূর পরাহতই থেকে যাচ্ছে। কারণ জনগণকে ভয় দেখিয়ে সঙ্গে আনার সেই পুরোনো দিনগুলো আর হয়তো ফিরে আসবে না। ১৯৯৬ সালে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ফায়দা এনে দিয়েছিল, এখন আর সেটা সম্ভব নয়। কারণ একবার ভয় ভেঙে গেলে আর জনগণকে ভয় দেখিয়ে সুবিধা লাভ করা যায় না। জুলাই বিপ্লবে জনগণের সেই ভয় ভেঙে গেছে। তবে এটা সত্য, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্রমাগত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে একপর্যায়ে জনগণ মনে করতে থাকে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় না আনলে এই সন্ত্রাস থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। কিন্তু সময় সবকিছু বদলে দেয়। আর সময়ই নির্ধারণ করে উত্থান-পতনের ইতিহাস, যে ইতিহাসের কাঠগড়ায় এখন আওয়ামী লীগ।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক