আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সারা দেশে ২৮,৬৬৩টি কেন্দ্রকে ঝুঁর্কিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিভিন্ন বাহিনীর শঙ্কা- নির্বাচনের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর হামলা, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই ও ভোটদানে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। এ সময় অবৈধ অস্ত্রের জোগানও আসতে পারে। এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী বিচারিক ক্ষমতা চেয়েছে। এ ছাড়া ইসির কাছে অবৈধ অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে সিআইডিকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্যও বলা হয়েছে।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং প্রাক-প্রস্তুতিমূলক বৈঠকে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকের কার্যপত্র থেকে উপরোক্ত তথ্য পাওয়া গেছে। বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দিন বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। নির্বাচন পরিচালনা একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। কমিশনের একার পক্ষে দেশব্যাপী এক দিনে নির্বাচনের মতো এত বড় কর্মমযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এজন্য সবার সম্মিলিত সহযোগিতা প্রয়োজন। আসন্ন নির্বাচনে অনেক প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে, সমন্বয় এবং আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা দূর করা সম্ভব হবে। সিইসি জানান, ‘স্ট্রেট অ্যাসেসমেন্ট করে ডেপ্লয়মেন্ট প্ল্যান করতে হবে। রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে বিভক্ত করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা করা যেতে পারে।’
বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধানের প্রতিনিধি জানান, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা, ভোটার ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য বাহিনীগুলোর মধ্যে আন্তসমন্বয় থাকতে হবে। নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর হামলা, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, ভোটদানে বাধা ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়াসহ বসতবাড়িতে হামলা বা অগ্নিসংযোগের আশঙ্কা থাকতে পারে। ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার আওতায় সারা দেশে ৬২টি জেলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা আছে। নির্বাচনের আগের তিন দিন, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচন-পরবর্তী চার দিনসহ মোট আট দিন সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখা যেতে পারে। তিনি জানান, সারা দেশে সেনাবাহিনীর ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ সেনা সদস্যকে নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিতকরণের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় অস্থায়ী ক্যাম্প নির্মাণ করা হতে পারে। সেনাবাহিনীকে এরই মধ্যে সরকার কর্তৃক ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, এর পাশাপাশি বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হলে নির্বাচনে সেনাবাহিনী আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে। তিনি বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যেতে পারে। নির্বাচনি কাজের জন্য সেনাবাহিনীকে ড্রোন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারে বিশেষ অভিযান অব্যাহত রাখা যেতে পারে। সেনাবাহিনী কর্তৃক সারা দেশে নির্বাচনি দায়িত্ব পালনের জন্য সম্ভাব্য ৪০০ কোটি টাকার মতো প্রয়োজন হতে পারে।
সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের পিএসও জানান, সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ নির্বাচনে সশস্ত্রবাহিনী মোতায়েনে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে। এ বিভাগ থেকে নৌবাহিনীর ৩ হাজার সদস্য, সেনাবহিনীর প্রায় ১ লাখ সদস্য মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে।
নৌবাহিনী প্রধানের প্রতিনিধি জানান, এবারের সুবিধা হলো এরই মধ্যে সারা দেশে নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনী মোতায়েন আছে। উপকূলীয় এলাকায় কিছু বিশেষত্ব থাকে। বিগত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ১১টি আসন উপকূলবর্তী। সাধারণত এলাকাগুলো চরাঞ্চল ও দুর্গম হয়ে থাকে; যার কারণে এখানে পরিবহন সমস্যা বিরাজমান। দীর্ঘদিন ধরে গাড়ি ক্রয়ের অনুমোদন না থাকায় যানবাহনের সংকট রয়েছে। নৌবাহিনীর নিজস্ব জলযান আছে, তবে সিভিল জলযানও লাগতে পারে। ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারের আওতায় সেনা ও নৌবাহিনী মোতায়েন থাকবে নাকি নির্বাচন কমিশনের আওতায় মোতায়েন থাকবে তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
আনসার ও ভিডিপি মহাপরিচালক বলেন, গতবারের নির্বাচনের সঙ্গে এবারের নির্বাচনকে তুলনা করলে ভুল হবে। কারণ এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন, ঝুঁকিগুলো ব্যতিক্রম। সাধারণ কেন্দ্রে দুটি অস্ত্রসহ এবং বিশেষ কেন্দ্রে তিনটি অস্ত্রসহ আনসারের টিম মোতায়েন থাকতে পারে। প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার নতুন আনসার-ভিডিপি নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। বড় চ্যালেঞ্জ তাদের পোশাক ও অস্ত্র। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র সচিব প্রতি ভোট কেন্দ্রে অন্তত একটি করে বড়িওর্ন ক্যামেরা রাখার কথা জানান। ভোট কেন্দ্রের আশপাশের দোকানগুলোকেও রেকর্ডিংয়ের আওতায় আনার অনুরোধ করেন। আকাশে ড্রোন উড়লে কেউ দুষ্কর্ম করার সাহস পাবে না বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ প্রস্তুতি নিচ্ছে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে। নির্বাচনে নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে। এ জন্য প্রশিক্ষণ ব্যয় বাড়বে। ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটির কার্যক্রম আরও দৃশ্যমান করা যেতে পারে। আচরণবিধি প্রতিপালনে ম্যাজিস্ট্রেটকে সহায়তা করার জন্য পুলিশ প্রস্তুত আছে।
বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, সীমান্তে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বজায় রেখে নির্বাচনে বিজিবি মোতায়েন থাকবে। সীমান্তে ২০ জনের বর্ডার আউটপোস্ট (বিওপি) মোতায়েন করা হবে না। তবে কক্সবাজারে ২৫ জন রাখা হবে। এবারে ৪৯২টি উপজেলায় ১১ হাজার ৬০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা সম্ভব হবে।
র্যাব মহাপরিচালক বলেন, নির্বাচনে র্যার মোবাইল টিম হিসেবে কাজ করে। নির্বাচনি কার্যক্রমের জন্য র্যাবের ড্রোন, হেলিকাপ্টারসহ অন্যান্য রিসোর্স ব্যবহার করা হবে। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধি প্রতিপালনে কমিশনকে কঠোর হতে হবে। এ কাজে ব্যর্থ হলে নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে। নির্বাচনে ৫ হাজার ৫০০ র্যাব সদস্য মোতায়েনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
সিআইডি-প্রধান জানান, সোশ্যাল মিডিয়া ও এআই ব্যবহার করে নির্বাচনে গুজব ছড়ানো হতে পারে। এরই মধ্যে এ ধরনের অনেক কনটেন্ট শনাক্ত করা হয়েছে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এ জন্য র্যাবের সাইবার ইউনিট কাজ করছে।
এসবির প্রতিনিধি জানান, ইতোমধ্যে এসবি ৮ হাজার ২২৬টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, ২০ হাজার ৪৩৭টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৩ হাজার ৪০০টি সাধারণ ভোট কেন্দ্রকে চিহ্নিত করেছে। এ ক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্রের ভৌত অবকাঠামো, খানা থেকে দূরত্ব, কেন্দ্রের নিকটবর্তী প্রভাবশালীদের বাসস্থান ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনকালীন অবৈধ অস্ত্রের জোগান আসতে পারে। অবৈধ অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে সিআইডিকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ২০২৬ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাহিনীগুলোকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি নিশ্চিত করেন যে, কমিশন গোপনে কোনো নির্দেশনা দেবে না, সব নির্দেশনা আইন ও বিধি মোতাবেক প্রকাশ্যে দেওয়া হবে। সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কমিশন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি বলেন, প্রতিপক্ষের হামলা, বিশৃঙ্খলা বা নির্বাচনি অনিয়মের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বস্তরে সমন্বয় প্রয়োজন। মাঠপর্যায়ে বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয় পদ্ধতি আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হবে।