নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের নামে দেশে একাধিক নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে এলসির আড়ালে বৈধ চ্যানেলেই কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন বাংলাদেশি এক ব্যবসায়ী। পাচার করা সেই অর্থে তিনি দেশে দেশে খুলেছেন কোম্পানি, সপরিবারে নাগরিকত্ব নিয়েছেন একাধিক দেশে। সেই ব্যবসায়ী আবার ইউসিবিএলের পরিচালকও হন। পরিচালক হয়েই নিজের গৃহিণী স্ত্রীকে বানান মেঘনা ব্যাংকের পরিচালক। পরে প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ লুটে নিয়ে সেই অর্থে দেশে-বিদেশে গড়েন বিপুল সম্পদ। ওই ব্যবসায়ীর অর্থ পাচার নিয়ে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের নিজস্ব অনুসন্ধান দল। এ ছাড়া কালবেলার অনুসন্ধানে ওই ব্যবসায়ীর অন্তত ১১০টি এলসির তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। সূত্রগুলো কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে, এলসির সংখ্যা আরও অন্তত কয়েকশ হতে পারে। এলসির আড়ালে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণও কয়েকশ কোটি টাকা হতে পারে। ওই ব্যবসায়ী হলেন ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বাংলাদেশের (পিএলসি) চেয়ারম্যান ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক বশির আহমেদ ওরফে মোহাম্মদ আব্দুল বারি।
নথিপত্র বলছে, বশির আহমেদ তার মালিকানাধীন ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বাংলাদেশের (পিএলসি) কর্মচারীদের নামে অন্তত চারটি শেল কোম্পানি খুলেছেন। এগুলো হলো নাজ ইন্টারন্যাশনাল, আলোক ইন্টারন্যাশনাল, রুদ্র ট্রেডিং ও জিএইচএম ট্রেডার্স। চারটি কোম্পানিরই ঠিকানা দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায়। তবে সরেজমিন এসব কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে নাজ ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক হিসাব ইউসিবিএলের নোয়াবাড়ী শাখায়, রুদ্র ট্রেডিংয়ের হিসাব চকবাজার শাখায় এবং আলোক ইন্টারন্যাশনাল ও জিএইচএম ট্রেডার্সের হিসাব জুবলী শাখায় পরিচালনা করা হয়। প্রথমে বশির আহমেদের মালিকানাধীন ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বাংলাদেশের (পিএলসি) ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ এসব শেল কোম্পানির হিসাবে জমা করা হতো। এরপর সেই টাকা দিয়ে এসব কোম্পানি থেকে এলসি খোলা হতো দুবাইয়ের প্যানমার্ক ইমপ্রেক্স মেগা ট্রেডিং এলএলসির অনুকূলে। এরপর ভারতীয় ক্যান্ডি ক্রয় করা হতো দুবাই থেকে। আর তা বাংলাদেশে ইমপোর্ট দেখানো হতো শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরের মাধ্যমে। সেই পণ্য খালাস দেখানো হতো চট্টগ্রামের বন্দর থেকে।
নথিপত্র বলেছে, ২০২৩ সালের ৫ জানুয়ারি আলোক ইন্টারন্যাশনালের নামে ২৪,৯৭৬.০৮ মার্কিন ডলারের একটি এলসি খোলা হয়। এলসি নম্বর ১০১৭২৩০১০০০২, শাখা ইউসিবিএলের কারওয়ান বাজার ব্রাঞ্চ। এলসিতে বেনিফিশিয়ারি দেওয়া হয় দুবাইয়ের প্যানমার্ক ইমপ্রেক্স মেগা ট্রেডিং এলএলসিকে। এলসি খোলার আগের দিন, অর্থাৎ ৪ জানুয়ারি বশির আহমেদের মালিকানাধীন ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি থেকে ২৭ লাখ টাকা ডিপোজিট করা হয় আলোক ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে। এ ছাড়া ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর আলোক ইন্টারন্যাশনালের নামে ১,৩৫,১৩৫ মার্কিন ডলারের একটি এলসি খোলা হয়। এলসি নম্বর ১০১৭২৩০১০১০৮। বেনিফিশিয়ারি দেওয়া হয় দুবাইয়ের প্যানমার্ক ইমপ্রেক্স মেগা ট্রেডিং এলএলসির অনুকূলে। এলসি খোলার আগে সেদিনই ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি থেকে ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ডিপোজিট করা হয় আলোক ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুবাইয়ের প্যানমার্ক ইমপ্রেক্স মেগা ট্রেডিং এলএলসির ১০০ শতাংশ শেয়ারের মালিক বশির আহমেদ। অর্থাৎ বশির আহমেদের বাংলাদেশি কোম্পানির হিসাব থেকে পাঠানো টাকায় প্রথমে এলসি খোলা হয় তার কর্মচারীদের নামে খোলা শেল কোম্পানির নামে। সেই শেল কোম্পানির হিসাব থেকে দুবাইয়ের যে কোম্পানিকে বেনিফিশিয়ারি দেখিয়ে এলসির টাকা পাঠানো হয়, সেই কোম্পানির মালিকও একই ব্যক্তি—বশির আহমেদ। দুবাইয়ে যে বশির আহমেদ বিক্রেতা, বাংলাদেশে তিনি ক্রেতা। বশির আহমেদের কর্মচারীদের নামে খোলা চারটি শেল কোম্পানির এরকম ১১০টি এলসির তথ্যপ্রমাণ রয়েছে কালবেলার হাতে, যার মোট মূল্য ৪.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। ব্যাংক সূত্র বলছে, প্রাথমিকভাবে ১১০টি এলসি শনাক্ত করা গেলেও এমন এলসির সংখ্যা আরও শতাধিক হবে।
নথিপত্র বলছে, দুবাইয়ে কোম্পানি খোলার সময় বশির আহমেদ নিজের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব গোপন করে কোম্পানির রেজিস্ট্রারে নিজেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাগরিক বলে দাবি করেন। এ ছাড়া দুবাইয়ে কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করতে ৩ লাখ আমিরাতি দিরহাম পরিশোধ করতে হয়েছে। কোম্পানিটির ঠিকানা দেওয়া হয়েছে—ইউনিট ১০৯, ২০ তলা, টুইন টাওয়ার (রোলেক্স টাওয়ার), দেইরা, দুবাই, ইউএই। কোম্পানিটির শতভাগ শেয়ার বশির আহমেদের নামে, যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৭৬৬২৩১।
এ ছাড়া তিনি প্যানমার্ক ইমপ্রেক্স মেগা ট্রেডিং লিমিটেড নামে আরও একটি কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন যুক্তরাজ্যে। সেই রেজিস্ট্রারে নিজেকে আবার দাবি করেছেন অ্যান্টিগা ও বারমুডার নাগরিক। প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে—অ্যাপার্টমেন্ট নম্বর ৩০২, ৩ মার্চেন্ট স্কয়ার, লন্ডন, ইংল্যান্ড। রেজিস্ট্রেশন নম্বর ১৩০৭৮৭৩২। কোম্পানিটির মালিকানায় রয়েছেন তার পরিবারের চার সদস্য—বশির আহমেদ, তার স্ত্রী তারানা আহমেদ, ছেলে ইয়ামেন আহমেদ ও মেয়ে আরওয়া বশির। রেজিস্ট্রেশনে তাদের সবাইকে অ্যান্টিগা ও বারমুডার নাগরিক এবং ইংল্যান্ডের বাসিন্দা দেখানো হয়েছে। তবে গত বছরের ১৬ অক্টোবর তারা পদত্যাগ করে ব্রিটিশ নাগরিক মোহাম্মদ রাহিকে কোম্পানিটির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
দেশে-বিদেশে যত সম্পদ: দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য মিলেছে বশির আহমেদ ও তার পরিবারের নামে। যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাজ্যে প্যানমার্ক ইমপ্রেক্স মেগা ট্রেডিং লিমিটেড নামে অফশোর কোম্পানির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ ছাড়া বশির আহমেদের নামে যুক্তরাজ্যে নিউক্যাসেলে বাড়ি রয়েছে, অ্যাপার্টমেন্ট নম্বর ২৮০৩, ওয়েস্টমার্ক টাওয়ার, ১ নিউক্যাসেল প্যালেস, লন্ডন, ডব্লিউ২ ১বি ডব্লিউ। বাংলাদেশে চট্টগ্রামের খুলশিতে অ্যাপার্টমেন্ট, যার দলিল নম্বর ১৫২৫১। ঢাকার বনানীতে ২১৮৬ এবং ২১৪০.৮৫ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। চট্টগ্রামের শাহ মিরপুরে স্থানীয় হিসাবে ৭ গন্ডা জমি, চরলক্ষ্যা এলাকায় ১৬ গন্ডা, একই এলাকায় আর এক দাগে ৭ গন্ডা জমি রয়েছে। ঢাকার কাঁঠালদিয়া এলাকায় ৩ কাঠা, আর এক জায়গায় ৭৭.৬৯ শতক জমি, গাজীপুরের মির্জাপুরে ১৭৭.৭৫ শতক জমি রয়েছে। ঢাকার পূর্বাচলে রয়েছে ১০ কাঠার একটি প্লট। এ ছাড়া বশির আহমেদের নামে বাংলাদেশে আরও প্রায় ৯টি কোম্পানিতে শেয়ার রয়েছে। এগুলো হলো বশির—মেসার্স ইয়ামান ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্সে ৮০ শতাংশ শেয়ার, বিঅ্যান্ডবি ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্সে ৯৫ শতাংশ শেয়ার, বার্ড ইন্টারন্যাশনালে ৮০ শতাংশ, ঢাকা ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্সে ২০ শতাংশ, ব্যাগ শিপিং এজেন্সিতে ৯৫ শতাংশ, বিঅ্যান্ডবি ফুড অ্যান্ড বেভারেজে ৬০ শতাংশ, মেটার ইম্পোরিয়ামে ৫০ শতাংশ, পেটাল এন্টারপ্রাইজে ৫০ শতাংশ ও অ্যারিস্ট্রন এন্টারপ্রাইজে রয়েছে ৫০ শতাংশ শেয়ার। এ ছাড়া প্রাইজবন্ড বা সঞ্চয়পত্র রয়েছে ৭২ কোটি ৮ লাখ ৫৮ হাজার ২১৪ টাকার এবং ২২ লাখ টাকা মূল্যের একটি নিজস্ব গাড়ি রয়েছে, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ-২১-৫২৪৩। এ ছাড়া বশির আহমেদের স্ত্রী তারানা আহমেদের নামে অন্তত ৭টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার রয়েছে, যার মূল্য ২০ কোটি টাকারও বেশি। তার নামে ৬৪ লাখ ৩৯ হাজার ৩০ টাকার প্রাইজবন্ড/সঞ্চয়পত্র ও ২৩ লাখ ৯৫ হাজার ৩২৩ টাকার এফডিআর এবং ৩২ লাখ টাকা মূল্যের একটি গাড়ি রয়েছে।
যা বলছে টিআইবি: জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘এটা অর্থ পাচার অবশ্যই। এটা পৃথিবীর প্রায় সব দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয়, সেটারই দৃষ্টান্ত। এটা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের নামে চালান জালিয়াতির মাধ্যমে মিস ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং করে আন্ডার ইনভয়েসিং করে অর্থ যে পাচার হয়, সেটারই একটা দৃষ্টান্ত। এই অর্থ পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘অর্থপাচার খুব কঠোর আইন। ১৪ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। সেইসঙ্গে যে পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে, তার তিন গুণ পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। কাজেই পুরো কোম্পানি এবং সহায়তার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা কী কারণে বাংলাদেশে কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড ও বেনিফিশিয়ারি ওনারশিপ ট্রান্সপারেন্সি চাই, এটা তার একটা দৃষ্টান্ত। অর্থাৎ কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে প্রকৃত মালিকানার তথ্য প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক এবং সেটা রেজিস্টারে থাকা। এই জিনিসটা না থাকার কারণে জালিয়াতি হয়ে থাকে। এর ফলে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এটা বন্ধ করতে হবে। শুধু সরকার পরিবর্তনের ফলে আমার দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ হয়েছে, সেটা বলার কোনো সুযোগ নেই। অর্থ পাচার যে এখনো হচ্ছে, হতে পারে, এটা মনে রাখতে হবে।’
অভিযোগ অস্বীকার বশির আহমেদের: সব অভিযোগ অস্বীকার করে বশির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘তিনি বাংলাদেশের সব আইন ও নিয়মকানুন মেনেই ব্যবসা করেছেন। তিনি কোনো অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত নন। শেল কোম্পানি খোলার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি দাবি করেছেন, কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তিনি ব্যবসা করেছেন এবং কোম্পানির সব লেনদেনই ব্যবসায়িক। যুক্তরাজ্যে তার কোনো সম্পত্তি নেই এবং বাংলাদেশে যে সম্পদ আছে তার সবই তার বৈধ আয়ের উল্লেখ করে এসব সম্পত্তি আয়কর রিটার্নে দেখানো আছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। এ ছাড়া দুবাইয়ে কোম্পানি খোলার সময় ৩ লাখ আমিরাতি দিরহাম পরিশোধের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। আর যুক্তরাজ্যে তার কোম্পানির ভ্যালু মাত্র ১ পাউন্ড বলে দাবি করেছেন বশির আহমেদ।