সরকারি প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রির অনুমোদন, হস্তান্তর ও নামজারি করার ক্ষেত্রে ঘুস সিন্ডিকেটের কবল থেকে অবশেষে রক্ষা পেতে যাচ্ছেন সেবাপ্রার্থীরা। এখন থেকে প্লট ও ফ্ল্যাটের লিজদাতা কর্তৃপক্ষ কিংবা সংস্থা এ বিষয়ে আর ভূমিকা রাখবে না। যেভাবে রেজিস্ট্রি অফিসে জমি কেনাবেচার দলিল সম্পাদন হয়ে থাকে, সেভাবে হবে। এজন্য কাউকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও সংস্থার দপ্তরে ছুটতে হবে না। জমি কেনার পর যে পদ্ধতিতে এসি ল্যান্ড বা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিসে নামজারি করা হয়, সেভাবে সবকিছু সম্পন্ন হবে। এর ফলে রাজউকসহ সরকারের এ সংক্রান্ত দপ্তরগুলোর দীর্ঘদিনের হয়রানি, দুর্নীতি ও জিম্মিদশা থেকে সেবাপ্রার্থীরা মুক্তি পাবেন।
নানা প্রতিকূলতা ও বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও জনস্বার্থে গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রণালয় বহুলপ্রত্যাশিত প্রজ্ঞাপনটি গেজেট আকারে জারি করতে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, রোববার সন্ধ্যায় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগ-১-এর উপসিচব ড. মো. নুরুল আমিন। এরপর প্রজ্ঞাপনটি গেজেট আকারে প্রকাশের জন্য রাতেই বিজি প্রেসে পাঠানো হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান সংস্কারের অংশ হিসাবে পূর্ত মন্ত্রণালয় এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে বিষয়টি নিয়ে এক মাস ধরে মন্ত্রণালয় একাধিক মিটিংসহ ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেয়। সূত্র জানিয়েছে, ভবিষ্যতে যাতে কোনো প্রভাবশালী চক্র এই সেবা কার্যক্রম সাবরেজিস্ট্রি অফিস ও এসি ল্যান্ডের দপ্তর থেকে ফেরত আনতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান সংশোধন করা হবে।
জানা যায়, জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে ৭টি নির্দেশনা রয়েছে। তবে প্রজ্ঞাপনের শুরুতেই বলা হয়েছে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাধীন বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কর্তৃক উন্নয়নকৃত আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাট হস্তান্তর-পরবর্তী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সেবা সহজীকরণ, লিজগ্রহীতাদের দুর্ভোগ ও হয়রানি লাঘব এবং দুর্নীতি দূরীকরণের লক্ষ্যে বিদ্যমান পদ্ধতি ও প্রথা পরিবর্তন করা হচ্ছে।
জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে দফাওয়ারি নির্দেশনায় বলা হয় : (১) গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাধীন বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কর্তৃক উন্নয়নকৃত ও বরাদ্দকৃত আবাসিক প্লট ও ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার, ক্রয়, দান বা হেবা সূত্রে নামজারি, হস্তান্তর (বিক্রয়, দান, হেবা বা বণ্টন) দলিল সম্পাদন বা বাতিল, আমমোক্তার দলিল সম্পাদন বা বাতিল এবং ঋণ গ্রহণের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন গ্রহণের বিদ্যমান প্রথা বাতিল করা হলো। এ প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ থেকে উপরিউক্ত কার্যক্রমের জন্য তফশিলে বর্ণিত আবাসিক প্লট ও ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন গ্রহণের আর প্রয়োজন হবে না। তবে লিজ দলিলের অন্যান্য শর্ত যেমন: কোনো প্লটের বিভাজন বা একাধিক প্লটের একত্রীকরণের মাধ্যমে প্লটের আয়তনের পরিবর্তন এবং প্লট বা ফ্ল্যাটের ব্যবহার শ্রেণির পরিবর্তন অর্থাৎ মাস্টার প্ল্যানের কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি গ্রহণের বর্তমান পদ্ধতি বহাল থাকবে। (২) দলিলগ্রহীতাকে উন্নয়নকৃত ফ্ল্যাট বা ভবনসহ ভূমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিল মূল্যের ২% (দুই শতাংশ) হারে এবং শুধু প্লট বা ভূমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিল মূল্যের ৩% (তিন শতাংশ) হারে অর্থ সাবরেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন দলিল সম্পাদনকালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুকূলে জমা প্রদান করতে হবে। এছাড়া গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং গণপূর্ত অধিদপ্তর কর্তৃক উন্নয়নকৃত প্লট বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে একই হারে ও পদ্ধতিতে মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে (প্রাতিষ্ঠানিক কোড নম্বর: ১৩২০১০১১১৮৮২৭, অর্থনৈতিক কোড নম্বর: ১৪২২৩১২) নন-ট্যাক্স রেভিনিউ (এনটিআর) হিসাবে আদায় করা হবে।
(৩) লিজকৃত সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কিত বিরোধ পরিহার এবং মালিকানা রেকর্ড লিজদাতা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ ও হালনাগাদ রাখার লক্ষ্যে প্লট বা ফ্ল্যাট হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিল সম্পাদনের পর অবিকল নকলের একটি কপি (সার্টিফাইড কপি) এবং নামজারির পর এ সম্পর্কিত রেকর্ডপত্র ক্রেতা বা ক্ষেত্রমতে দলিলগ্রহীতা কর্তৃক দলিল সম্পাদনের ৯০ দিনের মধ্যে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানে দাখিল করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাখিল করতে ব্যর্থ হলে দৈনিক ৫০ টাকা হারে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা আরোপ করা যাবে। হস্তান্তর দলিল বা নামজারি সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র লিজদাতা প্রতিষ্ঠানে দাখিলের ৩০ দিনের মধ্যে মালিকানা রেকর্ড হালনাগাদ করতে হবে। হালনাগাদকৃত রেকর্ডপত্র রেজিস্ট্রার্ড ডাকের পাশাপাশি ই-মেইল বা ইলেকট্রনিক অন্য কোনো মাধ্যমে ক্রেতা বা ক্ষেত্রমতে দলিলগ্রহীতাকে অবহিত করতে হবে; অথবা পাঠাতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে কর্তব্য-কর্মে অবহেলার দায়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(৪) লিজ দলিলের মেয়াদ শেষে (নিরানব্বই বছর পর) তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়নকৃত বলে গণ্য হবে এবং অনুচ্ছেদ (২)-এ বর্ণিত হস্তান্তর ফি আদায়ও রহিত হয়ে যাবে। তবে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের পূর্বানুমতি ব্যতীত প্লটের বিভাজন বা একাধিক প্লটের একত্রীকরণ, প্লট বা ফ্ল্যাটের ব্যবহার শ্রেণির পরিবর্তনসহ মাস্টার প্ল্যানের কোনো পরিবর্তন করা যাবে না।
(৫) আবাসিক ব্যতীত অন্যান্য (প্রাতিষ্ঠানিক, বাণিজ্য ও শিল্প) প্লট, ফ্ল্যাট বা স্পেসের হস্তান্তর ও নামজারিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে লিজদাতা কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন গ্রহণের বিদ্যমান প্রথা বহাল থাকবে।
(৬) যেসব আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে মালিকানা নিয়ে বিরোধ রয়েছে এবং ওই বিরোধে সরকারের স্বার্থের সংশ্লেষ রয়েছে; যেসব প্লট, ফ্ল্যাট বা বাড়ি গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে অথচ ১৯৮৮ সালের ২৮ মার্চের পর পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে অবমুক্ত করা হয়নি এবং যেসব আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাট জানুয়ারি ২০০৯ থেকে জুলাই ২০২৪ মেয়াদে বিশেষ বিবেচনায় বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সেসব প্লট, ফ্ল্যাট বা বাড়ির ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদন গ্রহণের বিদ্যমান প্রথা বহাল থাকবে। এ অনুচ্ছেদের অধীন লিজদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর অনুচ্ছেদ (২)-এ বর্ণিত পদ্ধতি ও হারে ক্রেতা বা ক্ষেত্রমতে দলিলগ্রহীতাকে প্রযোজ্য ফি পরিশোধ করতে হবে।
(৭) উপরে বর্ণিত বিধানাবলির আলোকে যেসব আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার, ক্রয়, দান বা হেবা সূত্রে নামজারি; হস্তান্তর (বিক্রয়, দান, হেবা বা বণ্টন) দলিল সম্পাদন বা বাতিল; আমমোক্তার দলিল সম্পাদন বা বাতিল এবং ঋণ গ্রহণের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন গ্রহণের প্রয়োজন হবে না, সেসব আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাটের তালিকা এ প্রজ্ঞাপনের অধীন, যথাশীঘ্রই সম্ভব তফশিল আকারে প্রকাশ করা হবে। তবে প্রকাশিত তফশিলে পরবর্তী সময়ে কোনো ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তা সংশোধনের ক্ষমতা কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করেন।