দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর দলটির দিকে তাকিয়ে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তাও আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যেকোনো ইস্যুতে এই দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থান জনমনে অস্বস্তি তৈরি করেছে।
বর্তমানে দল দুটির অবস্থান রীতিমতো দুই মেরুতে। আবার জাতীয় নাগরিক পার্টি—এনসিপিসহ অন্য দলগুলোও একেক সময় একেক দিকে ঝুঁকছে। এতে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেকের মনে নানা শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ফ্যাসিস্টদের নানাভাবে ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ ও গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে সুপারিশমালা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে তা নিয়ে তীব্র আপত্তি রয়েছে বিএনপির। দলটি বলছে, তাদের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি ছিল সনদে, কিন্তু সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়টি জুলাই সনদে না থাকলেও তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে এক দিনে গণভোটের কথা বলছে।
অন্যদিকে জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট দাবি করছে। তবে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষেই রয়েছে।
অবশ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁরা বলছেন, বিএনপি জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী দল।
অন্যদিকে ইসলামী রাজনৈতিক দল জামায়াত। ফলে দুই দলের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মতপার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আগেভাগে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে জামায়াত। এতে বোঝা যায়, আগামী নির্বাচনের আগে এই প্রক্রিয়ায় তারা তাদের শক্তিমত্তা জানান দিতে চাচ্ছে। তবে বিএনপি ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে। অযথা কোনো কর্মসূচি বা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। এটাকে ভালোভাবে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আরো বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত, যেসব ইস্যুতে নাগরিক স্বার্থ রয়েছে, সেখানে কঠোর থাকা। বিশেষ করে ভোটাধিকার প্রয়োগই এখন নাগরিকদের প্রধান দাবি। সে বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগী হওয়া। সরকার নির্ধারিত সময়েই জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কারণে মতবিরোধ থাকবে। তারা সবাই মিলে যাবে—এমনটি মনে করা ঠিক হবে না। তারা ক্ষমতায় গেলেও আলাদাভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। ফলে প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এটা একটা কম্পিটিশন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখা। যেসব ইস্যুতে নাগরিক স্বার্থ রয়েছে, সেখানে প্রভাব বিস্তার করা। ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাই সঠিক সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের অবস্থান সুদৃঢ় থাকতে হবে।’
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গণভোট আগে হবে, নাকি পরে হবে—এটাকে এখন প্রধান ইস্যু করা হচ্ছে। মূলত জামায়াতে ইসলামী এটা করছে। এটাও একটা ভুল রাজনীতি বলে আমরা মনে করি। জুলাই সনদে কী কী সংস্কার প্রস্তাব থাকবে এবং সেটার আইনি ভিত্তি কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, ড. ইউনূস সেই আদেশ জারি করবেন কি না—এগুলো তর্কের বিষয় হওয়া উচিত। এই জায়গাগুলোতে একমত হলে গণভোট, জাতীয় নির্বাচনের দিন কিংবা তার আগে যেকোনো সময়ই হতে পারে। কিন্তু গণভোট আগে হবে, নাকি ইলেকশনের দিন হবে এটা নিয়ে বিএনপি-জামায়াত দ্বন্দ্বে চলে গেছে। এটাকে আমরা একেবারেই অপ্রয়োজনীয় মনে করছি।’
রাজনীতির মাঠে বর্তমানে বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপির সরব ‘মতানৈক্য’ থাকলেও জাতীয় নির্বাচন ভণ্ডুলে ‘আওয়ামী লীগের তৎপরতাই’ মুখ্য বলে মনে করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিভিন্ন দলে ভিড়ে নির্বাচন ভণ্ডুলের ষড়যন্ত্র করবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন দল তৃণমূলে আওয়ামী লীগকে জায়গা দিচ্ছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রধমার্থে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দীর্ঘদিন পর নির্বাচন কমিশনও মানুষের ভোটাধিকার ফেরাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ অবস্থায় গত ২৮ অক্টোবর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেয়। যেখানে জুলাই সনদ নিয়ে প্রস্তাবিত গণভোট ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের দিনই হবে, নাকি তার আগেই অনুষ্ঠিত হবে, সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে গত ৩ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে সাত দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। সেই হিসেবে আজ সোমবার সাত দিন শেষ হচ্ছে।
এদিকে গত ৬ নভেম্বর নভেম্বর মাসেই গণভোট এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারিসহ পাঁচ দফা দাবিতে আগামীকাল মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) জামায়াতসহ আন্দোলনরত আটটি ইসলামী দল ঢাকায় মহাসমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে।
রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, আগে জামায়াত পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তুলে মাঠ গরমের চেষ্টা করেছিল। সেই দাবিতে হালে পানি না পেয়ে এখন তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে। জামায়াত নেতারা নভেম্বরের মধ্যেই গণভোটের দাবিতে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। এটা মূলত রাজনৈতিক কৌশল। বিএনপিকে চাপে ফেলে তাঁরা সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যদি গণভোট করতে হয় তাহলে তা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই হতে হবে। এ ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। এর বাইরে আর বলার কিছুই নেই। এখন সরকার যদি বিএনপির কাছে কোনো সহযোগিতা চায়, তাহলে তা আমরা করব। তবে নির্বাচনের আগে গণভোট মানবে না বিএনপি।’
জামায়াতে ইসলামীর হুঁশিয়ারিকে গণতন্ত্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে একটা প্রচেষ্টা চলছে, একটা চক্রান্ত চলছে গণতন্ত্রকে আবারও ধ্বংস করার জন্য। তবে গণভোট ইস্যুতে বিএনপি আগে যে অবস্থানে ছিল, জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে, সেই অবস্থানেই অনড় আমরা।’
বিএনপি মহাসচিব আরো বলেন, ‘বিএনপিকে অবজ্ঞা করলে ফল ভালো হবে না। বিএনপিকে খাটো করে দেখবেন না। আমাদের মাঠে নামতে বাধ্য করবেন না। আমরা যদি মাঠে নামি তবে টিকতে পারবেন না। আমরা মাঠে নামলে রাজনৈতিক বিষয়গুলো ভিন্নভাবে আসবে।’
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘গণভোটের দাবি কোনো চাপের মুখে উপেক্ষা করা হলে জাতীয় নির্বাচন সংকটে পড়তে পারে। তাই অবিলম্বে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে তার ওপর গণভোটের তারিখ ঘোষণা করতে হবে। তবে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে পারস্পরিক আলোচনাকে জামায়াতে ইসলামী স্বাগত জানায়।’
জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের যুক্তি তুলে ধরে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে প্রস্তাবিত গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। সময় স্বল্পতা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ব্যয় এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগ এবং একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে এবং একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে স্থায়ী কমিটির সভায় বিএনপি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত এবং গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাক্ষরিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এর প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন ও অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। বিএনপি বলেছে, ‘জুলাই সনদে বর্ণিত সব বিষয়কে আমরা ধারণ করি এবং দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী তা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আমরা আপনাদের সমর্থন করেছি, করব ওই সীমারেখার মধ্যে। আর যদি মনে করেন যে আরেকটি রাজনৈতিক দল দিয়ে আমাদের আহবান জানাবেন আলোচনার জন্য। তারা কারা? অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যদি আমাদের আহবান জানান কোনো বিষয়ে আলোচনার জন্য, যেকোনো ইস্যুতে, আমরা সব সময় আলোচনায় আগ্রহী, যাব। কিন্তু অন্য কোনো একটি রাজনৈতিক দল দিয়ে আমাদের আহবান জানানো হচ্ছে কেন?’
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, ‘আমরা বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলাম। তাঁরা বলেছেন, আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন না। আমরা যেকোনো সময় আলোচনায় বসতে রাজি আছি। প্রয়োজনে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে আলোচনায় বসতে উদ্বুদ্ধ করব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইস্যু কিন্তু খুব বেশি না। এখন মূল ইস্যু গণভোট ও জুলাই সনদের আদেশ জারি। জামায়াত ক্ষমতায় আসতে চায়। তাই বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে তারা নানা ইস্যু নিয়ে মাঠে নামছে। এটা রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে। আমার মনে হয়, তফসিল ঘোষণা হলে এগুলো থাকবে না, সবাই নির্বাচনের দিকে নজর দেবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে, রাজনৈতিক দলগুলোকে জানিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ও সিদ্ধান্তে অনড় থাকা।’