চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যুৎ বিভাগে লিফট কেনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট সম্প্রতি অন্তত ছয়টি প্রকল্পে নিম্নমানের লিফট সরবরাহ করে এই চক্র কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। প্রকল্পের টেন্ডারে ‘এ’ গ্রেড লিফট সরবরাহ করার কথা উল্লেখ ছিল।
কিন্তু বাস্তবে সরবরাহ করা হয়েছে ‘সি’ ও ‘ডি’ গ্রেডের লিফট। দরপত্রে প্রতিটি লিফটের দাম ধরা হয়েছে প্রায় এক কোটি ১৫ লাখ টাকা। কিন্তু যেসব লিফট সরবরাহ করা হয়েছে, সেগুলোর বাজারমূল্য ১৮ লাখ টাকার মতো। অর্থাৎ, নিম্নমানের এসব লিফট সরবরাহ করার মাধ্যমে ছয় প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে সাত কোটিরও বেশি টাকা। আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে এই দুর্নীতির তথ্য বের হয়ে এসেছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি টাকায় কেনা এসব নিম্নমানের লিফট ইতোমধ্যে একাধিক ভবনে স্থাপন করা হয়েছে। যেগুলো শুরু থেকেই নানা ধরনের জটিলতায় পড়ছে।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত বন্দরের বিদ্যুৎ বিভাগের পরিচালক এসএম সাইফুল ইসলাম, উপপ্রধান প্রকৌশলী মো. মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক এমপি আলি আজগর, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদের ব্যক্তিগত সহকারী ইঞ্জিনিয়ার আরশাদ পারভেজ। তারা বন্দরে গড়ে তুলেছেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নিয়মবহির্ভূতভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়াকে ‘ওয়ার্কস’ হিসেবে সম্পন্ন করে নির্দিষ্ট ঠিকাদার মো. জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে সুবিধা নিশ্চিত করেছেন তারা।
সরকারি ক্রয়বিধি অনুযায়ী, পণ্য শ্রেণির (গুডস) প্রকল্পে আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ টেন্ডারগুলো ‘ওয়ার্কস’ শ্রেণিতে নিয়ে গিয়ে তা এড়িয়ে গেছে। বন্দরের একাধিক কর্মকর্তা ও ইঞ্জিনিয়ার মনে করেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলীদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি স্বাধীন টেকনিক্যাল অডিট টিম গঠন করতে হবে। যারা সরবরাহ করা লিফটগুলোর মান যাচাই করে দেখবেন।
‘এ’ গ্রেডের টেন্ডার, ডেলিভারি নিম্নমানের
বন্দরের অভ্যন্তরীণ নথি ও প্রকল্প পর্যালোচনায় দেখা যায়, একই ধরনের অনিয়ম প্রায় সব দরপত্রেই ঘটেছে। ২০২২ সালে হওয়া এসব দরপত্রে অনিয়ম হয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকার বেশি। প্রথম প্রকল্প হচ্ছে বন্দরের চার নম্বর গেটের মুখে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিসিং বিল্ডিং’-এর জন্য চারটি ‘এ’ গ্রেডের লিফট সরবরাহ। দরপত্রে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মানের উচ্চক্ষমতার যাত্রীবাহী চারটি ‘এ’ গ্রেডের লিফট সরবরাহ করতে। লিফটগুলোর জন্য দরপত্রে চুক্তিমূল্য ধরা হয় চার কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। দরপত্র অনুযায়ী এক হাজার ৬০০ কেজি ধারণক্ষমতা এবং ২০ যাত্রীর উপযোগী এসব লিফট হবে ১০ তলা পর্যন্ত চলাচলযোগ্য। যার গতি হবে প্রতি সেকেন্ডে এক দশমিক ৭৫ থেকে দুই মিটার পর্যন্ত।
শর্ত অনুযায়ী লিফটটিতে থাকতে হবে সম্পূর্ণ যাত্রীবাহী কার, কন্ট্রোল প্যানেল, ট্র্যাকশন মেশিন, গিয়ারলেস ও অয়েল ফ্রি প্রযুক্তি, স্টিল সাসপেনশন রোপ, বিভিন্ন নিরাপত্তা সরঞ্জাম, গাইড রেল, পুশ বাটনসহ প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ। এছাড়া ভারসাম্য রক্ষার জন্য উপযুক্ত কাউন্টার ওয়েটও থাকতে হবে। লিফটটি বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী হতে হবে। ঠিক করে দেওয়া হয়েছে কিছু ব্র্যান্ডও। এগুলো হলোÑজাপানের ফুজিটেক কোম্পানি, হিটাচি, মিৎসুবিশি; ফিনল্যান্ডের কোনে; যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্সের ওটিস, সুইজারল্যান্ডের শিন্ডলার এবং জার্মানির থাইসেনক্রুপ। যে কোম্পানি লিফট সরবরাহ করবে, তাদের নিজস্ব কারখানায় কমপক্ষে ১০ মিটার/সেকেন্ড গতির লিফট তৈরির সক্ষমতা থাকতে হবে এবং ৬০ বছরের বেশি উৎপাদন অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
কিন্তু বন্দরের চার নম্বর গেটের মুখে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিসিং বিল্ডিং’-এর জন্য সরবরাহ করা হয়েছে ‘ডি’ গ্রেডের লিফট। সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনের কাজ এখনো শেষ হয়নি। চারটি লিফট স্থাপন করা হয়েছে ওই ভবনে। লিফটে লেখা আছে ফুজাও, ফুজি এলিভেটেড কো. লি., চায়না। বাজার যাচাই করে দেখা গেছে, ফুজাও কোম্পানির লিফটের দাম ১২ থেকে ১৮ লাখ টাকা।
এ প্রকল্পের কাজ পায় ঠিকাদার মো. জাহাঙ্গীর আলমের ‘এ অ্যান্ড জে ইন্টারন্যাশনাল’। তার প্রতিষ্ঠান এই চারটি নিম্নমানের লিফট সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে প্রতিটি লিফট থেকে প্রায় এক কোটি করে মোট চার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন এই ঠিকাদারসহ বন্দরের বিদ্যুৎ বিভাগের সাইফুল ইসলাম, মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক এমপি আলি আজগর, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদের ব্যক্তিগত সহকারী ইঞ্জিনিয়ার আরশাদ পারভেজ।
একইভাবে ২০২২ সালে বন্দর হাসপাতাল সংলগ্ন ফার্স্ট ক্লাস অফিসার্স কোয়ার্টারের জন্য ‘এ’ গ্রেডের লিফট সরবরাহের জন্য দরপত্রের আহ্বান করা হয়। কিন্তু একই ঠিকাদার কোম্পানি সেখানেও ‘বি’ গ্রেডের লিফট সরবরাহ করে। যার মাধ্যমে প্রায় এক কোটি ৫০ লাখের বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। তৃতীয় প্রকল্পে অফিসার্স ডরমিটরি ভবনের জন্য ‘এ’ গ্রেডের লিফট সরবরাহের শর্ত দেওয়া হলেও এখানে সরবরাহ করা হয় ‘সি’ গ্রেডের লিফট। যাতে বন্দরের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। একইভাবে স্টোর ভবন, কার শেড ও প্রশাসনিক ভবনেও নিম্নমানের লিফট সরবরাহ করা হয়। এভাবে ছয়টি প্রকল্পে সাত কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়া হয়।
সিন্ডিকেট বানিয়ে অর্থ লোপাট
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই লিফট সরবরাহে জড়িত তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ অ্যান্ড জে ইন্টারন্যাশনাল ও ম্যাক্সওয়েল, সিমেন্স পাওয়ার প্লাস, এবিএম ওয়াটার কোম্পানি ও গ্রিন ডট। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক হচ্ছেন মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. শাখাওয়াত হোসেন ও আতাউল করিম সেলিম। বন্দরের বিদ্যুৎ বিভাগে প্রজেক্ট বণ্টনে তারা সিন্ডিকেট বানিয়ে প্রভাব খাটান বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন বন্দরের ওই দুই কর্মকর্তা ও আরশাদ পারভেজ।
একজন ঠিকাদার জানান, এখন বন্দরে টেন্ডার মানে এক ধরনের ‘প্যাকেজ’ সিস্টেম। আগে থেকেই ঠিক করা থাকে কোন ঠিকাদার কাজটি পাবেন, আর বাকিরা শুধু নামমাত্র দরপত্র জমা দেন। সবকিছু যেন শুধু আনুষ্ঠানিকতা! সরকারি ক্রয়বিধি অনুযায়ী লিফট কেনা ‘গুডস’ বা পণ্য শ্রেণির প্রকল্প হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। কিন্তু বন্দরে এই টেন্ডারগুলো করা হয়েছে ‘ওয়ার্কস’ বা নির্মাণকাজের শ্রেণিতে, যা মূলত ভবন বা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রযোজ্য। এভাবে টেন্ডারের শ্রেণি বদলে দেওয়ার ফলে প্রকৃত প্রতিযোগিতা সীমিত হয়ে যায় এবং নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারের পক্ষে সুবিধা তৈরি হয়।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের (পাবলিক ওয়ার্কস বিভাগ) নিয়ম অনুযায়ী ‘এ’ গ্রেড লিফটে উচ্চমানের নিরাপত্তা, জরুরি বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, ইউরোপীয় গিয়ারিং সিস্টেম ও সার্টিফায়েড কন্ট্রোল ইউনিট থাকতে হয়। কিন্তু বন্দরের বেশিরভাগ ভবনে স্থাপিত লিফটগুলোতে এসব উপাদান অনুপস্থিত। বন্দরের এক কর্মচারী বলেন, বিভিন্ন ভবনে লাগানো লিফটগুলো বারবার আটকে যাচ্ছে। সার্ভিসিং করতে হয় ঘন ঘন। তবুও কর্তৃপক্ষ চুপ।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সিন্ডিকেটভুক্ত কয়েকজন কর্মকর্তা সম্প্রতি বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার হাতে রয়েছে।
এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের মতো কৌশলগত একটি প্রতিষ্ঠানে এভাবে বছরের পর বছর ধরে একই ধরনের অনিয়ম চলা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দরপত্রে এক কোটি ১৫ লাখ টাকার লিফট চাওয়া হয়েছিল; কিন্তু ঠিকাদার দিয়েছেন ১৮ লাখ টাকার লিফট। বাকি টাকা যোগসাজশে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির স্পষ্ট দৃষ্টান্ত।
আখতার কবির মনে করেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের উচিত এখন পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা। এতে গলদ কোথায় বের হয়ে আসবে।
লিফটগুলো নিয়ে প্রকৌশলীদের নানা প্রশ্ন
চট্টগ্রাম বন্দরে স্থাপিত লিফটগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিদ্যুৎ বিভাগের তিনজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, দরপত্রে যদি ‘এ’ গ্রেড লেখা থাকে, তাহলে সেটি অবশ্যই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের, ইউরোপ বা জাপানে তৈরি এবং নির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত মান পূরণকারী হতে হবে। কিন্তু বন্দরে যেসব লিফট বসানো হয়েছে, তা দূর থেকেই বোঝা যায় সেগুলো ‘সি’ গ্রেডের চায়না প্রোডাক্ট।
আরেকজন প্রকৌশলী বলেন, ‘এ’ গ্রেড লিফটের মোটর গিয়ারলেস হয়, কন্ট্রোল ইউনিট থাকে ইউরোপীয় সনদপ্রাপ্ত এবং সাসপেনশন রোপ হয় কার্বন-স্টিলের। কিন্তু বন্দরের বেশিরভাগ লিফটে এই উপাদানগুলোর কোনোটিই নেই। এটা শুধু মানহীনই নয়, জীবনের ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে।
এই প্রকৌশলী আরো বলেন, সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এই প্রকল্পগুলো পণ্য হিসেবে নয়, ওয়ার্কস হিসেবে টেন্ডার করা হয়েছে। অর্থাৎ, টেকনিক্যাল বিষয়গুলো যাচাই করা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে। এটা স্পষ্টত দুর্নীতির একটি অপকৌশল। ওয়ার্কস প্রকল্পে নির্দিষ্ট ঠিকাদারকে অগ্রাধিকার দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য। তাদের মতে, বন্দরে ইতোমধ্যে স্থাপিত লিফটগুলোর মান যাচাই ও নিরাপত্তা পর্যালোচনার জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের বাইরে থেকে একটি স্বাধীন টেকনিক্যাল অডিট টিম গঠন করা জরুরি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঠিকাদার মো. জাহাঙ্গীর আলমকে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার দেশকে বলেন, কোন ধরনের লিফট সরবরাহ করা হয়েছে, এটি প্রকৌশলীরা ভালো বলতে পারবেন। আমি-আপনি তো প্রকৌশলী নই। নিশ্চয়ই যেভাবে চাওয়া হয়েছে, ঠিক ওইভাবেই সরবরাহ করা হয়েছে। আপনি তো ঠিকাদার, আপনি না জানলে কে জানবে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যুৎ বিভাগের পরিচালক এসএম সাইফুল ইসলাম বলেন, সরেজমিনে দেখুন, তারপর প্রতিবেদন লিখুন।
এসব প্রকল্পে সরবরাহ করা লিফট নিম্নমানের-এই প্রতিবেদক তা দেখেছেন জানানো হলে তিনি বলেন, ঠিকাদারের অফার, চুক্তির সংস্থান এবং সরবরাহ একই না হলে কোনো মালামাল সরকারি কাজে গ্রহণযোগ্য হবে না। উপপ্রধান প্রকৌশলী মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে একাধিকবার কল ও মেসেজ পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি। পরে অফিসে গিয়েও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ পারসোনাল অফিসার মো. নাসির উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, এরকম ঘটনা ভয়াবহ দুর্নীতিরই অংশ। আমরা অবশ্যই এ বিষয়ে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।