Image description

আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের বাম দলগুলোর নেতারা যে সমীকরণ নিয়ে এগোচ্ছিলেন, বর্তমান বাস্তবতায় তাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপির প্রথম ধাপের মনোনয়ন ঘোষণার পর গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা হতাশ হয়েছেন বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে ন্যূনতম আলোচনা না করে মনোনয়ন ঘোষণা করা বিএনপির অদূরদর্শী পদক্ষেপ। এতে গণতন্ত্র মঞ্চ ও বিএনপির মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব বেড়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। অন্যদিকে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা মনে করছেন, দূরত্ব বাড়লে রাজনীতির ক্ষেত্রে সেটা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। ওদিকে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা নির্বাচনী জোট গড়ার উদ্দেশ্যে প্রগতিশীল দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টায় আছেন। কিন্তু নির্বাচনী পরিকল্পনায় নেই ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা।

গত ৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ১২০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। এতে গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকা-৮, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬, জেএসডির সহ-সভাপতি তানিয়া রব লক্ষ্মীপুর-৪, সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ফেনী-৩, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ূম কিশোরগঞ্জ-৫ এবং ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলুকে জামালপুর-৫ আসনের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬, লক্ষ্মীপুর-৪, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে মনোনয়ন দেয়নি বিএনপি।

জানা গেছে, ঢাকা-৮ আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। বিএনপির কাছে প্রত্যাশা ছিল আসন সমঝোতায় তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। কিন্তু ওই আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ফেনী-৩ আসনে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কিন্তু ওই আসনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু জামালপুর-৫ আসন নিয়ে ভাবছেন, কিন্তু ওই আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও জামালপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহ মো. ওয়ারেছ আলী মামুনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ (বাঞ্ছারামপুর) আসনে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন গণতন্ত্র মঞ্চের আরেক শরিক গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। যদিও তাঁর আসনে বিএনপি এখনও মনোনয়ন ঘোষণা করেনি। নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২ আসনে মনোনয়ন চেয়েছেন, ওই আসনে বিএনপি মনোনয়ন দেয়নি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সহ-সভাপতি তানিয়া রব লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ওই আসনেও মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ুমের প্রত্যাশিত কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে কাউকে মনোনয়ন দেয়নি বিএনপি।

এর মধ্যে ১২ দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যে আসন সমঝোতার কথা রয়েছে। এতে করে গণতান্ত্রিক জোটের শরিকদের প্রত্যাশায় ছেদ পড়ার শঙ্কা রয়েছে। যে কারণে ওই শরিকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবুও হাল ছাড়ছেন না তাঁরা; শেষ পর্যন্ত আলোচনা করে যাবেন।

এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক আমাদের সময়কে বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে আলোচনার আগেই কয়েকটি নির্বাচনী আসনে বিএনপি এককভাবে প্রার্থী ঘোষণা করায় গণতন্ত্র মঞ্চের ভেতরে ক্ষোভ ও মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপির এ রকম মনোনয়ন ঘোষণা ‘অদূরদর্শী পদক্ষেপ’। এতে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব বেড়েছে। আগামী দুই-চার দিনের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে অগ্রগতি হতে পারে। এই বোঝাপড়ার জায়গাটা যদি ভেঙে যায়, তাহলে রাজনৈতিক ঝুঁকিটা অনেক বড়। এটা বিএনপি ও আমাদের উভয়েরই উপলব্ধিতে থাকা দরকার।

তিনি জানান, মঞ্চ শুধু বিএনপির সঙ্গে নয়, বাম প্রগতিশীল দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনায় আছে- যদিও এখনও কোনো সমন্বিত প্রার্থী তালিকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তাঁর ভাষায়, আমরা চেষ্টা করছি যাতে অন্তত রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও নৈকট্য অটুট থাকে। নির্বাচনে আসন সমঝোতা হবে কিনা- সেটা আলোচনার মধ্য দিয়েই নির্ধারণ হবে।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ কাফী রতন আমাদের সময়কে জানান, তাঁরা আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের তালিকা ১২ নভেম্বর প্রকাশ করবেন। ১৪ নভেম্বর তাঁদের মহাসমাবেশ আছে। সেখানে প্রগতিশীল দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। এরপর বাম জোটের প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে।

বাম জোটের সমন্বয়ক বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপির সঙ্গে আমাদের কোনো নির্বাচনী জোট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নির্বাচনের প্রশ্নে আমরা আলাদা অবস্থানেই আছি। তিনি বলেন, দলগুলো ১৫ নভেম্বর একটি রাজনৈতিক কনভেনশন আয়োজন করতে যাচ্ছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক পরিসর ও আন্দোলনের করণীয় নির্ধারণ করাই এই কনভেনশনের মূল লক্ষ্য। বাম দলগুলোর এক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী জোটের কোনো সম্ভাবনা নেই।

তিনি বলেন, আগে বিভিন্ন দলকে নির্বাচনী পরিকল্পনার তালিকা জমা দিতে বলা হয়েছিল। কয়েকটি দল তালিকা দিয়েছে, বাকিগুলো জমা দিলে আমরা আলোচনায় যাব। তবে বাম জোট এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার অনেক দল এই নির্বাচনে অংশ নাও নিতে পারে। আমরা ১৫ নভেম্বর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমিক-কৃষকসহ শ্রেণি-পেশার সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক কনভেনশন করব। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাম প্রগতিশীল শক্তির করণীয় কী- সেখান থেকে একটি দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে।

এছাড়া গণফোরাম ও বাংলাদেশ জাসদসহ আরও কয়েকটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক জোটের আলোচনা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে এখনই বলার মতো পরিস্থিতি হয়নি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান জানান, তাঁরা বাম জোটের শরিকসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ১৫ নভেম্বর জাতীয় কনভেনশন করছেন। ওই কনভেনশনের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর বাম জোট গড়ার দিকে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, বাম জোট ছাড়াও ইতোমধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ-গণফোরামসহ অনেকের সঙ্গে আলোচনা করেছি, দেখা যাক।

বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন, নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চা, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের (মাহবুবুল), গণমুক্তি ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট ইউনিয়ন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চ, সমন্বিত ফ্যাসিবাদ বিরোধী বাম মোর্চার সূত্রে জানা গেছে, তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে না।