Image description

সরকারি সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে শ্রীলংকা সরকার। প্রায় তিন হাজার সরকারি ভবনকে অর্ধনির্মিত, অব্যবহৃত বা পরিত্যক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে দেশটি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে এসব স্থাপনা নিজ দপ্তরে কাজে লাগানো বা কেন্দ্রীয় কোনো সংস্থার অধীনে দিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে কমিউনিটি হল, বহুমুখী ভবন, সরকারি বাসভবন, স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট স্থাপনা, গুদামঘর, সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প-সংক্রান্ত ভবন, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এমনকি আদালত ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, করদাতাদের টাকায় নির্মিত অবকাঠামো থেকে কার্যকর ফল পেতে ভবনগুলোকে পুনরায় সক্রিয় করে প্রয়োজনে ভাড়া বা লিজে দেয়ার বিকল্প খোঁজা হবে। সে লক্ষ্যে দপ্তরভিত্তিক বিস্তৃত অডিট চলছে। দেশটির গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, এটি আইএমএফ নিয়ন্ত্রিত আর্থিক পুনর্গঠনের অংশ। ২০২২ সালে দেউলিয়া হওয়ার পরবর্তী সময়ে দেশটি যে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে রয়েছে, তার মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। যার অংশ হিসেবে পড়ে থাকা এসব ভবনকে সম্পদে রূপান্তর করার উদ্যোগ নিয়েছে অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে সরকার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশেও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনেক সরকারি আবাসন, অফিস, আদালত, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো অবকাঠামো পতিত অবস্থায় রয়েছে। পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অসংখ্য শ্বেতহস্তী প্রকল্প নেয়া হয়। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণের পর অনেক প্রকল্পে লোকসান গুনতে হচ্ছে। কোনো কোনো প্রকল্প পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। শ্রীলংকা সরকার জনগণের অর্থের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করার উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো এ ধরনের সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যদিও মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কিছু অবকাঠামো ব্যবহার উপযোগী করার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের আবাসনের সুবিধার্থে রাজধানীর মিরপুর–৬ নম্বর সেকশনের শিয়ালবাড়ী এলাকায় ছয়টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ভবনের অধিকাংশ ফ্ল্যাট পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে খালি। কর্মকর্তারা সেখানে যেতে আগ্রহী নন। সেকশনের কাঠের কারখানা এলাকায় পাঁচটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কাঠের কারখানা ও শিয়ালবাড়ী এলাকার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। দুই এলাকার এ ১১টি ভবনের প্রতিটি ১৪ তলা। এসব ফ্ল্যাটে কর্মকর্তাদের ওঠার জন্য সরকারের আবাসন পরিদপ্তর থেকে বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

অব্যহৃত বা পড়ে থাকা অবকাঠামোর তালিকা করে বেসরকারি উদ্যোগে হলেও চালু করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ও ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘শ্রীলংকার মতো অব্যবহৃত অবস্থায় থাকা সরকারি অবকাঠামোর তালিকা অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে অগ্রাধিকার দিয়ে করতে পারত। এটা খুবই সহজ ছিল। কোন মন্ত্রণালয়ের কোন প্রকল্প পতিত অবস্থায় বা অর্ধনির্মিত অবস্থায় রয়েছে সে তালিকা পাঠানোর শুধু একটা নির্দেশ দিয়ে দিলেই হতো। প্রয়োজনে একটা কমিটি করা যেত। এ সহজ কাজটি সরকার করতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে এখনো জরুরি ভিত্তিতে তালিকা করতে পারে।’

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গণপূর্ত অধিদপ্তর সারা দেশে বেশকিছু সরকারি আবাসন নির্মাণ করে। সে আবাসনগুলোর কোনোটি পুরোপুরি খালি পড়ে আছে। আবার কোনোটি পড়ে আছে নির্মাণাধীন অবস্থায়। গণপূর্ত অধিদপ্তরের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও সড়ক ও জনপথের আওতায় নির্মিত অনেক স্থাপনা অব্যবহৃত পড়ে আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি প্রশিক্ষণ অবকাঠামোর অনেকগুলো দীর্ঘদিন অব্যবহৃত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক, মেডিকেল ট্রেনিং সুবিধা—এগুলোতেও ব্যবহার ঘাটতি দেখা যায়। কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিসিক ও বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক স্থাপনা ও কোয়ার্টারে অনুরূপ স্থবিরতা রয়েছে। এছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ইউনিয়ন পর্যায়ের ভবনগুলোও খালি পড়ে থাকার নজির আছে।

এ প্রসঙ্গে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের কোন কোন ভবন পরিত্যক্ত পড়ে আছে সে তালিকা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কাছে আছে। তবে সমন্বিত কোনো তালিকা সরকার করেনি। বরং যে মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের আওতায় অবকাঠামো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, তারা চেষ্টা করছে সেগুলো চালু করার। গত সরকার এমন অনেক প্রকল্প নিয়েছে, যেগুলো চাইলেও সহজে ফাংশনাল করা সম্ভব নয়। এ দুই কর্মকর্তা আরো জানান, অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে অনেক অবকাঠামোই ফাংশনাল করতে পারত। মিরপুরসহ দেশের অনেক স্থানে গণপূর্তের আবাসন দীর্ঘ সময় ধরে খালি আছে। সরকার চাইলে কাউকে ভাড়া দিয়ে দিতে পারত। এদিকে আসলে সে অর্থে মনোযোগ দেয়নি সরকার।

সরকারি আবাসন কিংবা কোনো অবকাঠামো ব্যবহার উপযোগী না হওয়ার পেছনে সঠিক সমীক্ষার অভাবকে দায়ী করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের (ইউআরপি) অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় বা বড় কোনো শহরে আবাসন খালি পড়ে থাকার কথা না। সরকারি সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করতে এখন যে প্রকল্পগুলো খালি আছে সেগুলো তালিকা করে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরগুলোকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। ভবিষ্যতে এ করম প্রকল্প করার আগে উপযোগিতার বিষয়ে সমীক্ষা করতে হবে। সমীক্ষা সঠিক না হলেই এ ভুল হয়ে থাকে।’

গত সরকারের আমলে নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের জন্য নির্মিত ছয়টি ১৫ তলা ভবন খালি পড়ে আছে প্রায় ছয় বছর ধরে। ভবনগুলোতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা থাকতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বলে জানিয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের একটি সূত্র। নথিপত্র অনুযায়ী, আলীগঞ্জে ছয়টি ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৪০২ কোটি টাকা। পরে ২ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ে। শুরুতে আটটি ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল। তবে পরে তা কমিয়ে ছয়টি করা হয়।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আবাসন পরিদপ্তরের অফিস থেকেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়া হয়। সংস্থাটির মো. আসাদুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি যে ভবনগুলো খালি পড়ে আছে সেগুলো যেন বরাদ্দ দিতে পারি। এ মুহূর্তে মিরপুরে কিছু আবাসন খালি আছে। নারায়ণগঞ্জেও খালি আছে। আসলে ঢাকা থেকে তো কেউ নারায়ণগঞ্জে যেতে চায় না। আমরা চেষ্টা করছি যানবাহনের ব্যবস্থা করে হলেও সেগুলো ব্যবহার উপযোগী করার।’