খুলনা মহানগরীর ২ নম্বর কাস্টমঘাটে গত ৬ অক্টোবর রাত পৌনে ৮টায় সন্ত্রাসীরা মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে ইমরান মুন্সিকে (৩৫)। নিহত ইমরান মুন্সি স্থানীয় মুন্সিপাড়া দ্বিতীয় গলির বাসিন্দা বাবুল মুন্সির ছেলে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল ‘পলাশ’ নামের একটি সন্ত্রাসীচক্র। হত্যাকাণ্ডের শিকার ইমরান মুন্সি ছিলেন আরেক চক্র ‘গ্রেনেড বাবু’র সদস্য।
গত ২ নভেম্বর আড়ংঘাটা থানার যোগীপোলে বিএনপি কার্যালয়ে বোমা হামলা, গুলি ও হত্যার ঘটনায়ও সন্দেহের তীর এখন একাধিক সন্ত্রাসীচক্রের দিকেই। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আশিক, নূর আজিম, হুমা, গ্রেনেড বাবুসহ কমপক্ষে ১২টি চক্র। তবে সবচেয়ে বেশি দাপট রয়েছে আশিক, নূর আজিম, গ্রেনেড বাবু ও হুমা চক্রের। এই চক্রগুলো নিয়েই এখন আলোচনা বেশি হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একসময় খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ছিল সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীদের স্বর্গভূমি। গত প্রায় দেড় দশক সেই পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়। গত বছরের ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, গত প্রায় ১৪ মাসে মহানগরীতেই ৩৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
নগরীতে বেশি প্রভাবশালী বলে শীর্ষে রয়েছে আশিক চক্র। এই বাহিনীর প্রধান আশিক। তিনি নগরীর চানমারী এলাকার বাসিন্দা। ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রথম হত্যা মামলায় জড়িয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত হন তিনি। বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে ১২টি মামলা। এই দলে সদস্য রয়েছে ২৫ থেকে ২৬ জন। এই চক্রের প্রধান সহকারী ফয়সাল। তিনিও নগরীর দক্ষিণ টুটপাড়ার বাসিন্দা। প্রত্যেক সদস্যের বিরুদ্ধেই থানায় একাধিক মামলা রযেছে। আশিকের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র কারবার, ভাড়াটে হিসেবে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে।
নূর আজিম চক্রের প্রধান শেখ নূর আজিম। তিনিও নগরীর টুটপাড়ার বাসিন্দা। কিশোর গ্যাং সৃষ্টির মাধ্যমে ২০১৬ সালে তিনি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। তাঁর নামেও বিভিন্ন থানায় কমপক্ষে ১২টি মামলা রয়েছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এই চক্র অস্ত্রের দিক থেকে শক্তিশালী। খুলনার দৌলতপুরের আলোচিত যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লা, ঘুমন্ত অবস্থায় তানভীর হাসান শুভসহ গত সাড়ে তিন মাসে নগরীর দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশায় তিনটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়া কুপিয়ে জখম এবং প্রকাশ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় জড়িত রয়েছে হুমা চক্র। সর্বশেষ যোগীপোল ইউনিয়নের বিএনপি নেতা মামুন শেখকে লক্ষ্য করে গুলি এবং শিক্ষক ইমদাদুল হক হত্যায়ও এই চক্রের নাম উঠে এসেছে। এই চক্রের প্রধান হুমায়ুন কবির হুমা (৩৭)। তিনি দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা বণিকপাড়ার বাসিন্দা মতলেব শেখের ছেলে । তাঁর বিরুদ্ধে একটি হত্যা, একটি অস্ত্র এবং দুটি চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। গত বছরের ৯ অক্টোবর বাগেরহাটের রামপালে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। চলতি বছরের ২৪ জুলাই জামিনে মুক্তি পেয়ে হয়ে উঠেছেন বেপরোয়া।
গত ১১ জুলাই দুপুরে মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ার বাড়ির সামনে গুলি করে এবং পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয় সাবেক যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে। এ ঘটনায় হুমার সহযোগী কাজী রায়হান, আসিফ মোল্লাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সম্প্রতি কুয়েট এলাকায় সাবেক ইউপি সদস্য ও যুবলীগ নেতা আরিফ হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় হুমা, তাঁর অনুসারী আসিফ মোল্লা ও রায়হান পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।
খুলনায় দীর্ঘদিনের রাজত্ব চালাচ্ছে গ্রেনেড বাবু চক্র। এটির নেতৃত্বে রয়েছেন রনি চৌধুরী। তিনি নগরীর শামছুর রহমান রোডের মিন্টু চৌধুরীর ছেলে। ২০১০ সালে হত্যা মামলা করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। মাদক কারবারে আধিপত্য ধরে রাখার জন্য ওই বছরের ১০ জুন সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীর হোসেন কচি নামের এক মাদক কারবারিকে তিনি হত্যা করেন। এ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বাবু পলাতক রয়েছেন। তবে মহানগরীর বাইরেও সংঘটিত অপরাধে উঠে আসছে গ্রেনেড বাবুর নাম।
গত আওয়ামী লীগ আমলে দাপুটে ছিল পলাশ চক্র। তবে এক পর্যায়ে দলীয় কোন্দলে ছিলেন পর্যুদস্ত। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ফের সক্রিয় হয়েছেন পলাশ। দেশি ও বিদেশি অস্ত্র, লোকবল তৈরি করে দ্রুত আধিপত্য জানান দিতে শুরু করেন তিনি। সর্বশেষ ১৮ অক্টোবর কারাগারে গ্রেনেড বাবুর সহযোগী কালা তুহিন ও পলাশ চক্রের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ থামাতে কারারক্ষীরা লাঠিপেটা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর ডিবি পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, খুলনার সন্ত্রাসী চক্রগুলোর দ্বন্দ্ব এখন প্রকট। এক চক্র অন্য চক্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। আধিপত্য, চাঁদাবাজি নিয়ে দ্বন্দ্বে প্রতিনিয়ত হত্যা ও হামলার ঘটনা ঘটছে। এসব অপরাধী দ্রুত স্থান পরিবর্তন করছে। ফলে তাদের আটক ও গ্রেপ্তার করা খুব সহজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা। স্থানীয় লোকজনও ভয়ে তাদের সম্পর্কে পুলিশকে তথ্য দিতে চায় না।
খুলনা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মোহাম্মদ রাশিদুল ইসলাম খান বলেন, পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে চলছে। এরই মধ্যে নির্বাচনের প্রভাব পড়েছে। কেউ যাতে এই সময়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।