Image description

চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি এখন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। একক আধিপত্য বিস্তার করতে সন্ত্রাসীদের এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নিধনে নেমেছে। টার্গেট করেই প্রতিপক্ষকে হত্যা করছে তারা। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, বালুর ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ নানা কারণে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা নিজেদের রক্ষায় দলবদল করে রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের অস্ত্র যেমন উদ্ধার হয়নি, তেমনি গত বছরের ৫ আগস্টের পর থানা বা ফাঁড়ি থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। উলটো বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দেশে আরও অস্ত্র ঢুকছে। এভাবে চট্টগ্রাম মহানগরী ও উত্তর চট্টগ্রামের রাউজান এলাকায় সন্ত্রাসের হটস্পটে পরিণত হয়েছে।

বর্তমানে দাপিয়ে বেড়ানো ৬টি গ্রুপের অর্ধশত সন্ত্রাসী বর্তমানে আন্ডারওয়ার্ল্ডে সক্রিয় রয়েছে। তাদের সবার হাতেই রয়েছে ভারী ও হালকা অস্ত্র। চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন. বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রেফতারে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ১৪ মাসে কেবল রাউজানেই রাজনৈতিক বিরোধে ১৪টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। ৬৫টি সংঘাত-সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম মহানগরী ও রাউজানে সরাসরি টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৬টি। সর্বশেষ বুধবার চট্টগ্রামের চালিতাতলীতে আগামী নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উলাহ গুলিবিদ্ধ হন। ওই হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা। প্রকাশ্যে গণসংযোগের সময় শত শত মানুষের সামনে ঘাড়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যার ঘটনা চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

বাবলা হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে তার বাবা আবদুল কাদের বাদী হয়ে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় মামলা করেন। এতে বিদেশে পলাতক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদ এবং তার বাহিনীর কিলিং স্কোয়াডের প্রধান হিসাবে পরিচিত রায়হান আলমসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর অন্য আসামিরা হলেন-বোরহান উদ্দিন, নেজাম উদ্দিন, আলাউদ্দিন, মোবারক হোসেন ওরফে ইমন ও হেলাল ওরফে মাছ হেলাল। ভারতে বসে এক সপ্তাহের সময় দিয়ে তিন দিনের মাথায় বাবলাকে হত্যা করা হয়। একই এলাকায় অটোরিকশাচালক ইদ্রিস আলী হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হন। বুধবার সন্ধ্যায় চালিতাতলীতে হামলার পর রাত ১২টায় রাউজানের বাগোয়ানে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়। এভাবেই চলছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর থেকে রাউজান ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। জেল থেকে বের হওয়া এবং বিদেশ ফেরত সন্ত্রাসীরা নতুনরূপে আবির্ভূত হয়েছে। তারা একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে। চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদকে গ্রেফতারের পর আন্ডারওয়ার্ল্ডে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। এ পর্যন্ত যত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সবগুলোতেই নাম এসেছে ছোট সাজ্জাদের প্রধান সহযোগী রায়হানের।

এইট মার্ডার, চাঞ্চল্যকর লিয়াকত আলী মার্ডারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সাজ্জাদ আলী খান বিদেশে অবস্থান করলেও সেখান থেকেই তিনি চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন। তার গ্রুপের ৬ সন্ত্রাসীর নাম এখন সবার মুখে মুখে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের অপকর্মে অস্থির।

বড় সাজ্জাদ বিদেশে এবং ছোট সাজ্জাদ জেলে থাকলেও তাদের অবর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছে রায়হান আলম, মোবারক হোসেন ইমন, শহিদুল ইসলাম বুইস্যা ও ইসমাইল হোসেন টেম্পু। এছাড়া আগ্রাবাদ ও হালিশহর আংশিক এলাকায় কমিশনার আব্দুল কাদের প্রকাশ মাছ কাদের, পাহাড়তলী ও বায়েজিদ এলাকায় সাবেক কমিশনার জসিম উদ্দিনের কিছু সন্ত্রাসী রয়েছে। চান্দগাঁও এলাকায় যুবলীগের এস্কান্দর আলী, চান্দগাঁও ও আকবর শাহ এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ঢাকাইয়া আকবর অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন। রায়হানের নেতৃত্বে ঢাকাইয়া আকবরকে ২৫ মে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে গুলি করে হত্যা করা হয়।

উদ্ধার হয়নি লুট হওয়া অনেক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি : ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন বা ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সিএমপির আটটি থানা ও আটটি ফাঁড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। তখন ৮১৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৪৪ হাজার ৩২৪টি গুলি লুট হয়েছিল। এক বছর পেরিয়ে গেলেও লুণ্ঠিত এসব অস্ত্র ও গুলির বেশির ভাগই উদ্ধার হয়নি। আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের অস্ত্রভান্ডারও অক্ষত রয়েছে। আর থানা থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্রও চলে গেছে সন্ত্রাসীদের হাতে।

৬-৭ পয়েন্ট দিয়ে আসছে অবৈধ অস্ত্র : চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হলেও উলটো সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে আরও অস্ত্র ঢুকছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, থানচি, নেফিউপাড়া, তমব্রু, কক্সবাজারের টেকনাফের কুতুপালং ও উখিয়া দিয়ে আসা এসব অস্ত্র আন্ডারওয়ার্ল্ডে যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া নাফ নদী দিয়ে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনচিপ্রাং, উলুবনিয়া ও টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা, দমদমিয়া, জাদিমুরা, নয়াপড়া এবং টেকনাফ সদর ইউনিয়নের বরইতলী খাল দিয়েও আনা হয় অস্ত্র। রোহিঙ্গারাই এ রুটগুলোর অস্ত্র পাচারে নেপথ্যে কাজ করছে। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে এ দেশে অস্ত্র পাচারে সক্রিয় রয়েছে ১০টি চক্র। এর মধ্যে আছে আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সশস্ত্র চারটি দল আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। মিয়ানমার থেকে আসা বেশির ভাগ অস্ত্রই চলে আসে চট্টগ্রামের অপরাধী চক্রগুলোর কাছে। সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এসব পয়েন্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

২১ জুলাই নগরের চান্দগাঁওয়ে ‘সন্ত্রাসী’ ইসমাইল হোসেন ওরফে টেম্পো ও শহিদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যার বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়। পরে পুলিশ বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার এলাকায় সন্ত্রাসী বুইস্যার আস্তানার সন্ধান পায়। সেখানে লুট হওয়া দুটি গুলি ও গুলির খোসা পাওয়া যায়। ২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট নগরের বায়েজিদ-হাটহাজারী থানার সীমানাসংলগ্ন কুয়াইশ এলাকায় মাসুদ কায়সার ও মো. আনিস নামে দুই ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়। সেগুলোও লুট করা গুলির খোসা বলে নিশ্চিত হয় পুলিশ।

ভয়ংকর সন্ত্রাসী রায়হান ধরাছোঁয়ার বাইরে : সরোয়ার হোসেন বাবলা হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পরও সন্ত্রাসী রায়হানকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার বিরুদ্ধে সাতটি হত্যাসহ সবমিলে ১৫টি মামলা রয়েছে। পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাউজান ও চট্টগ্রাম নগরীতে যে কটি টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে এর সবকটিতেই নেতৃত্ব দিয়েছে এই রায়হান। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলায় একের পর এক হত্যা মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। পুলিশ তাকে ধরতে সক্রিয় দাবি করলেও রায়হানের নাগাল পায়নি। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান, ফটিকছড়ি ও রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি এলাকায় তার গোপন আস্তানাও রয়েছে বলে জানা গেছে।

পুলিশের বক্তব্য : সিএমপির গণসংযোগ শাখার সহকারী কমিশনার আমিনুর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসী গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ কাজ করছে। কিন্তু রায়হানসহ ভয়ংকর কিছ সন্ত্রাসী রয়েছে যারা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেই পাহাড়ে আত্মগোপন করে। এতে তাদের গ্রেফতার করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের ধরতে ডিবির একাধিক টিম মাঠে কাছ করছে। বিভিন্ন এলাকায় অভিযানও পরিচালনা করা হয়েছে।