চলতি অর্থবছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতে জরুরি ব্যয়ের জন্য অতিরিক্ত তিন হাজার ৪২২ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। বিদেশি ঋণ বা অনুদান ছাড়া এই অর্থ পুরোপুরি আসবে দেশীয় উৎস থেকে। মূল বাজেটের বাইরে এই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হবে জনস্বাস্থ্য খাতে কিছু জরুরি প্রয়োজন মেটাতে, অসমাপ্ত প্রকল্প শেষ করতে এবং নতুন বৃহৎ স্বাস্থ্য কর্মসূচি অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত সেবা কার্যক্রম সচল রাখতে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়টি এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে তিনটি পৃথক এক বছর মেয়াদি প্রকল্পের প্রস্তাব জমা দিয়েছে, যা যাচাই-বাছাই শেষে আগামীকাল সোমবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উঠছে।
প্রকল্প তিনটির সময়সীমা হবে জুলাই ২০২৫ থেকে জুন ২০২৬ সাল পর্যন্ত। এক বছর মেয়াদি এই উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা যেন মাঝপথে ব্যাহত না হয়, সেই ব্যবস্থা সচল রাখাই মূল লক্ষ্য। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এর মাধ্যমে শেষ হওয়া চতুর্থ ধাপের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) বাকি কাজ সম্পন্ন করা হবে এবং নতুন পঞ্চম ধাপের কর্মসূচি অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে জমা দেওয়া তিনটি প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশন প্রাথমিকভাবে পর্যালোচনা করেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের বিশ্লেষণ বলছে, প্রস্তাবিত তিন হাজার ৪২২ কোটি টাকার মধ্যে দুই হাজার ১৮১ কোটি টাকা বা ৬৩.৯১ শতাংশ ব্যয় হবে রাজস্ব খাতে। বাকি এক হাজার ২৪১ কোটি টাকা বা ৩৬.০৯ শতাংশ যাবে উন্নয়ন বা মূলধনী খাতে। ব্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ রাখা হয়েছে গর্ভনিরোধক, ওষুধ, প্রতিষেধক ও বিভিন্ন চিকিৎসাসামগ্রী কেনার জন্য।
অন্যদিকে অবকাঠামো বা উন্নয়ন খাতে বড় অংশ ব্যয় হবে ভবন নির্মাণ ও সংস্কারে। এ খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ৮৫৮ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুনে শেষ হওয়া এইচপিএনএসপির চতুর্থ ধাপের মোট ব্যয় ছিল ৪৯ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। যার ৩৮ শতাংশের বেশি অর্থায়ন এসেছিল বিদেশি ঋণ ও অনুদান থেকে। এখন ধারাবাহিকতা রক্ষায় মন্ত্রণালয় পঞ্চম ধাপের কর্মসূচি (এইচপিএনএসপি-ভি) প্রস্তাব করেছে, যার সম্ভাব্য ব্যয় এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি। এ কর্মসূচিতে বিদেশি সহায়তার অংশ ধরা হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। কিন্তু নতুন কর্মসূচি অনুমোদনের প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ায় মধ্যবর্তী সময়ের জন্যই নেওয়া হয়েছে এই তিনটি এক বছর মেয়াদি অস্থায়ী প্রকল্প।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগের মতো বড় সেক্টর প্রোগ্রাম হিসেবে নয়, বরং প্রকল্পভিত্তিক স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নকাজ এগিয়ে নেওয়া হবে। ১৯৮৪ সাল থেকে স্বাস্থ্য খাতে সেক্টরভিত্তিক প্রোগ্রামের প্রচলন থাকলেও বাস্তবতায় নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বাজেট ব্যবস্থাপনা, প্রকল্প তদারকি ও বিদেশি অনুদান ব্যবহার। প্রায় ৫০টি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) বৈঠকের পর নতুন এই কাঠামোর সিদ্ধান্ত আসে।
এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ থেকে একাধিক প্রকল্প প্রস্তাব জমা পড়লেও পরিকল্পনা কমিশন অনুমোদন স্থগিত রাখে। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করে, প্রকল্পগুলো সময়ের আগেই জমা দেওয়া, বাস্তবতা যাচাইয়ের ঘাটতি, কিছু খাতে অস্বাভাবিক বেশি ব্যয় এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা। তবে সম্প্রতি প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে নিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম একটি ডিও লেটার পাঠিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কাছে; যাতে তিনটি প্রকল্পের অনুমোদন দ্রুত সম্পন্ন করার অনুরোধ করা হয়।
এই তিন প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বড়টি বাস্তবায়ন করবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা, যার প্রায় ৭০ শতাংশই ব্যয় হবে গর্ভনিরোধক, ওষুধ ও টিকা কেনায়। অবকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৫০ লাখ টাকা। প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য হচ্ছে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমানো, কিশোরী গর্ভধারণ প্রতিরোধ এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সচল রাখা।
দ্বিতীয় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মোট ব্যয় এক হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা, যার প্রায় ৭৫ শতাংশই যাবে হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ক্লিনিক ও অন্যান্য ভবনের নির্মাণ ও সংস্কারে। বাকি অংশ ব্যবহৃত হবে প্রশাসনিক ব্যয়, তদারকি ও প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রমে।
তৃতীয় প্রকল্পটির ব্যয় তুলনামূলক কম, ২১২ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়ন করবে চিকিৎসা শিক্ষা অধিদপ্তর, জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর। এই প্রকল্পে মূলত স্বাস্থ্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, অসমাপ্ত গবেষণা ও জরিপ সম্পন্ন (যেমন—বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে এবং হেলথ ফ্যাসিলিটি সার্ভে) এবং সিমুলেশন ল্যাব ও গবেষণাগার আধুনিকায়ন করা হবে। ব্যয়ের প্রায় ৮৮ শতাংশই গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে যাবে, আর ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে ল্যাব সংস্কার ও ছোটখাটো মেরামতে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এই তিনটি প্রকল্প অনুমোদন পেলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় কোনো ধরনের ছেদ পড়বে না। নতুন বৃহৎ কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত পরিবার পরিকল্পনা, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা শিক্ষা—এই তিন খাতেই কার্যক্রম চলমান থাকবে। তাঁরা আশা করছেন, দ্রুত অনুমোদন পেলে তিন প্রকল্পের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে, যা দেশের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) আব্দুর রউফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে চলে আসা পঞ্চম জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচি বাতিল হওয়ায় অনেক কাজ থমকে আছে, যেগুলো জরুরি। সেই বিবেচনায় নতুন প্রকল্প অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত এই তিনটি প্রকল্প এক বছরের জন্য অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।’