টেলিকম খাত সংস্কারের নামে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন যে নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো কেবল বিদেশি কোম্পানি, বিশেষ করে দেশের তিনটি টেলিকম অপারেটরকে সুবিধা দেবে বলে অভিযোগ তুলেছেন দেশীয় উদ্যোক্তাদের।
তারা বলেছেন, এতে বিভিন্ন স্তরের কয়েক হাজার স্থানীয় কোম্পানি ব্যবসা হারাবে। এসব আইন ও নীতিমালার সরাসরি বিরোধিতায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে মোর্চা গঠনের কথাও উঠেছে ঢাকার এক অনুষ্ঠানে। এমনকি আদালতে যাওয়ার কথাও বলেছেন তারা।
শনিবার ঢাকার একটি হোটেলে বাংলাদেশর টেলিকম খাতের সাংবাদিকদের সংগঠন টিআরএনবি আয়োজিত মতবিনিময় সভায় অংশ নেন টেলিকম খাতের মধ্যস্তরে থাকা এনটিটিএন, আইজিডব্লিউ, আইসিএক্স এবং ইন্টারনেট সেবাদাতা আইএসপির প্রতিনিধিরা। টেলিকম খাতের বিশ্লেষক ও সাংবাদিকরাও বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে টিআরএনবির সহসভাপতি রাশেদ মেহেদী একটি ধারণাপত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবাদাতা মার্কিন কোম্পানি স্টারলিংক বাংলাদেশে নতুন এসেছে, তার জন্য সরকার লাইসেন্স একুইজিশন ফি করেছে ১০ হাজার ডলার, যা ১২ লাখ টাকার মতো। সেখানে আমাদের দেশীয় একজন ইন্টারনেট সেবাদাতা বা আইএসপির (ন্যাশন ওয়াইড) লাইসেন্স একুইজিশন ফি ২৫ লাখ টাকা। প্রশ্নটা হলো, স্টারলিংক বড় কোম্পানি, নাকি আমাদের দেশীয় আইএসপি বড় কোম্পানি। এটার যুক্তিটা কী?”
নতুন আইনে টেলকো খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে ক্ষমতাহীন করে ‘রাবার স্ট্যাম্প’ প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলা হচ্ছে মন্তব্য করে রাশেদ মেহেদী বলেন, “টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশের (খসড়া) ৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, টেলিকম খাতে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে বিটিআরসি এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। পাঁচজন সচিবের নেতৃত্বে একটা কমিটি হবে, আবার তার ওপরে থাকবেন পাঁচজন মন্ত্রী। এর মানে হলো, পাঁচজন মন্ত্রী আসলে পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করবেন। আবার কোন লাইসেন্সটা ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ’, তার কোনো ডেফিনেশন ওখানে পরিষ্কার নাই।”
প্রয়োজনে আইনের আশ্রয়
দেশের ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, আমাদের এখানে আড়াই হাজার ছোট-বড় উদ্যোক্তা আছে। এখানে প্রায় ছয়-সাত লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের ওপর নির্ভরশীল আছেন ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ।
“নীতিমালায় মোবাইল অপারেটরদের বলা হয়েছে, সেলুলার মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডার (সিএমএসপি) আর আমাদের বলা হয়েছে ফিক্সড টেলিকম সার্ভিস প্রোভাইডর (এফটিএসপি)। নামকরণের মধ্যেই বলা আছে, আমরা ফিক্সড সার্ভিসটা দেব, আর ওনারা দেবে মোবিলিটি। কিন্তু গাইডলাইনের অপর পক্ষে বলা হচ্ছে যে, ওনারাও বাসা-বাড়িতে ফাইবার কেবল নিয়ে যেতে পারবে, ওনারাও ফিক্সড লাইন দিতে পারবে। তাহলে আমাদের ওরা ব্যবসা করবে কীভাবে?”
তিনি বলেন, “সংস্কার হচ্ছে মচমচে কথা, শুনতে ভাল লাগে।”
প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথা জানিয়ে আমিনুল হাকিম বলেন, “যতদূর শুনেছি ১৩ তারিখের মধ্যেই এই চারটা গাইডলাইন অনুমোদন হয়ে যাবে। এখানে আমাদের সেফগার্ড যদি না থাকে, তাহলে আমরা কী করব। তখন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া আমাদের উপায় থাকবে না। সেই ক্ষেত্রে সকলকে অনুরোধ করব আইনের আশ্রয় নেন।”
উল্টোপথে দেশ
ফাইবার সেবাদাতা (এনটিটিএন) ফাইবার অ্যাট হোমসের ডিএমডি সুমন আহমেদ সাবির বলেন, “আপনি যদি বিদেশি একটা প্রতিষ্ঠান হন, আপনি বাংলাদেশের যেকোনো লেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারবেন। কিন্তু আপনি দেশীয় উদ্যোক্তা হলে সেই সুযোগ নেই।
“আমার সামনে আমিনুল হাকিম (আইএসপিএবির সভাপতি) বসে আছে। ও একটা আইসপির কর্তা ব্যক্তি, এখন একটা সাবমেরিন কেবলের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। তাহলে দেশীয় উদ্যোক্তা হিসেবে ওনাকে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে হবে, উনি কি আইএসপি ব্যবসা করবেন, নাকি উনি অন্য লেয়ারে যাবেন।”
তিনি বলেন, “বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য আবার যদি আপনি দেখেন, মোবাইল অপারেটর চাইলে ফাইবার নিয়ে একদম বাসা পর্যন্ত কানেক্টিভিটি দিতে পারবে। তাহলে আসলে আইএসপিরা কী করবে। অত বড় একটা ফিনান্সিয়্যাল মাসল পাওয়ারের সঙ্গে ছোট ছোট লাইসেন্সি যারা দুই-তিন হাজার সংখ্যায় হবেন তারা কী লড়াই করে টিকে থাকতে পারবে? এটা যদি সত্যি ব্লু প্রিন্ট হয় তাহলে পরিষ্কার করে বললেই হয়। আমরা এখন থেকেই বন্ধ হয়ে যাই, বিদেশিরাই আসুক তাদের ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে।”
তিনি বলেন, “এই পলিসিতে একটা গ্রুপের জন্য সব জায়গায় প্লে করার সুযোগ আছে। এটা বন্ধ না হলে আমাদের দেশীয় উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার তেমন কোনো সুযোগ দেখি না।”
সাবির আহমেদ বলেন, “এটা আগের পলিসির পুরোপুরি উল্টো। আগের পলিসির উদ্দেশ্য ছিল লোকাল উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করা। এখন যেটা হচ্ছে সেটা উল্টো। আবার বৈশ্বিকভাবে দেখলে এখানে সাইবার ওয়ারফেয়ারের একটা বিষয় আছে। সেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। কাজেই এই সেক্টরটা কি আমরা পুরোপুরি বিদেশীদের হাতে তুলে দিব, নাকি ক্রমান্বয়ে আমরা চেষ্টা করব আমাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার। একটা সময় ছিল বাংলাদেশের টেলিকম খাত বিদেশিদের ছাড়া চিন্তা করা যেত না। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। দেশে এমনও প্রতিষ্ঠান আছে, যারা সম্পূর্ণ দেশীয় ভিত্তিতে টেলিকম সেবা পরিচালনা করতে পারে। সেই সক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি।”
সুমন আহমেদ বলেন, “মোবাইল অপারেটরদেরও চ্যালেঞ্জ আছে। তাদের যে রেভিনিউ তাদের যে কস্ট, এক-দুইজন খুব বেশি প্রফিট করছে বাকীরা করতে পারছে না। এখন তাদের বাঁচানোর জন্য কী করা দরকার সেটা সরকারকে ঠিক করতে হবে। তবে সেটা দেশীয় উদ্যোক্তাদের ব্যবসার বিনিময়ে হওয়া উচিৎ না। আমাদের সবাইকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া উচিৎ হবে না।”
ইন্টারনেটে নজরদারীর বিষয়টি বলতে গিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বন্ধ করে দেওয়ার প্রসঙ্গ টানেন সুমন আহমেদ সাবির।
তিনি বলেন, “একটা সময় ছিল ডিওটি (টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর) ও এনটিএমসির অত্যাচার। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিরুদ্ধ মতগুলোকে ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে দেওয়া। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় দেখলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বন্ধের নির্দেশনা এসেছে আমাদের কাছে। খুলে দেখলাম সেখানে সাবেক সেনাপ্রধানের যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে, সেখানে তার ভাইয়ের পরিচয়ও দেওয়া হয়েছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। দুই ঘণ্টা পর রিপোর্ট বদলে গেল, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমও চালু করে দেওয়া হলো।”
“এর বাইরে কিন্তু ডিওটি এবং এনটিএমসি আর কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। তাদের উচিৎ ছিল ইন্টারনেটের অপব্যবহার হচ্ছে কিনা, সেগুলো নজরদারি করা। নতুন বাস্তবতায় আমাদের আশা ছিল কিছু তথ্য সরকার শেয়ার করবে। সাইবার সিকিউরিটি, আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো আমাদের কোনো পলিসিতেই কাভার করা হচ্ছে না। নতুন বোতলে পুরনো মদ টাইপের বিষয়গুলোই আমরা দেখছি। জুলাই পরবর্তী সরকারের কাছে আমরা এগুলো প্রত্যাশা করি নাই।”
টেলিকম সংস্কারে এত আগ্রহ কেন?
আইসিএক্স কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধি নুরুল আলম বলেন, আইসিএক্স, আইজিডব্লিউ, আইআইজি এবং নিক্স- এই চারটি লেয়ার বাতিল হয়ে যাবে বর্তমান খসড়া আইনে।
তিনি বলেন, “জ্বালানী, শিক্ষা, চিকিৎসা অন্য কোনো খাতে এত সংস্কার হয়নি। এই খাতে এত সংস্কার কেন, সেটা আপনারা ভেবে দেখেন।”
প্রযুক্তি নীতিমালা বিশ্লেষক আবু নাজম মো. তানভীর হাসান বলছেন, “গত ছয়মাস ধরে আমাদের অবস্থা জেরবার। গত ছয়মাস ধরে এই সেক্টরে এতগুলো নতুন পলিসি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে যে আমরা আসলে সেগুলো পড়েই কুলাতে পারছি না। ”
খসড়া নীতিমালায় ‘ইন্টারনেট বন্ধ করা যাবে না’ বলে যে ধারা সংযোজন করা হয়েছে, সেটিকে ‘স্টান্টবাজি’ উল্লেখ করে আবু নাজম বলেন, “এর আগে দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে দায় নেওয়ার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। এটা একটা প্রটোকল থাকা উচিৎ, যেন রাষ্ট্র তার বিশেষ প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে নির্দিষ্ট একটা এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ রাখতে পারে।”
বিশেষ মিশনে সরকার?
এই সরকার বিদেশিদের সব দিয়ে দেওয়ার মিশন নিয়েই এসেছেন বলে মন্তব্য করেন সাংবাদিক মাসুদ কামাল।
তিনি বলেন, “এই সরকার এই চরিত্র নিয়েই এখানে এসেছে যে, বিদেশিদের কাছে যতটা দেওয়া যায়, সরকার ততটা দিয়ে যাবেন এবং সেটা নির্লজ্জভাবে দেবেন। যে খাতগুলো লাভজনক, সেখানে বিদেশিদের আনছেন একটার পর একটা। তারা কোনো রিস্ক নেবেন না, শুধু ক্রিমটা উঠিয়ে নেবেন। ভাবেন তো চট্টগ্রাম পোর্টের কথা। তারা বলছেন, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোম্পানিকে তারা দিচ্ছেন। একটা প্রকিউরমেন্ট ল তো আছে বাংলাদেশে, সেটাও মানা হয়নি। কোনো টেন্ডার হয়নি। ওনার মনে হয়েছে এটা শ্রেষ্ঠ, অতএব এটাকে ওনারা দেবেন।”
তিনি বলেন, “এই সরকার যত দিন আছে, এদের কাছে ভাই কান্নাকাটি করলে আপনার চোখের পানিটাই নষ্ট হবে। তারা একটা মিশন নিয়ে আসছে। একটু ভরসার কথা শুনতে পাচ্ছি, এই মিশন বোধ হয় তারা ফেব্রুয়ারি পর্যন্তই পাচ্ছে, যদি তারা কথা রাখে। তবে কথা না রাখার মতো অনেক কারণ তারা করছে, তাদের ওপর কেউ আস্থা রাখে না।”
নীতিমালা যখন উল্টারথে
আইজিডব্লিউ ফোরামের সিওও মুশশিক মনজুর বলেন, আশির দশকে দেশের ওষুধের বাজার পুরোটাই ছিল বিদেশি কোম্পানিগুলোর দখলে। হিস্টাসিন বা কফ সিরাপের মতো কিছু প্রডাক্ট দেশে তৈরি হতো। কিন্তু সরকার যখন আশির দশকে নীতিমালা করল তখন দেশীয় উদ্যোক্তারা এগিয়ে গেলেন। দেশীয়দের দাপটে বিদেশি কোম্পানিগুলো গুটিয়ে গেছে ২০ বছরের মধ্যেই। এখন পুরো বাজার দেশীয় কোম্পানিগুলোর দখলে।
এই উদাহরণ দিয়ে মুশফিক বলেন, “সরকারের নীতি দেশীয় শিল্পকে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। এখানে উল্টো করা হচ্ছে। যেখানে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট দরকার, সেখানে ফোকাস না করে যেখানে আমাদের দেশীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে এতদিনে, সেটাকে নষ্ট করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
“যদি ফার্মাসিউটিক্যালে আমরা মাল্টিন্যাশনালদের সরিয়ে দিতে পারি প্রপারলি বিজনেস করে, তাহলে কেন টেলিকমে পারবে না?”