Image description

এতদিন গ্রাম-গঞ্জের মাঠ-ঘাট, ঝোপ-জঙ্গলে সাপের দেখা মিলতো। সম্প্রতি রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় দেখা মিলছে শঙ্খ গোখরা, খোয়া গোখরা, রাসেল ভাইপারের মতো বিষধর সাপ। কখনো বাসাবাড়ির ঘরের মধ্যে, কখনো গাড়ির পার্কিংয়ে, প্লে-গ্রাউন্ডে, কখনো আবার বহুতল ভবনের ৯/১০ তলা বাসা ও ছাদের উপরেও পাওয়া যাচ্ছে সাপ। এ নিয়ে রাজধানী জুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক। রাজধানীর উত্তরা, মোহাম্মদপুরের বছিলা, কাফরুল, বনশ্রী, মিরপুর, খিলগাঁওসহ বেশ কিছু এলাকার বাসিন্দা জানিয়েছেন, প্রতিনিয়তই তারা বিশাল আকৃতির সাপের দেখা পাচ্ছেন। যার মধ্যে গোখরার সংখ্যাই বেশি। একই বাসা থেকে ডিমসহ ২৭টি সাপ উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। শ্রাবণ বিশ্বাস নামে উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরের রাজউকের আবাসন প্রকল্পের কপোতাক্ষ ভবনের এক বাসিন্দা বলেন, সাপ এখন আমাদের এখানে নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে গেছে। প্রায় দিনই সাপের দেখা মিলছে। তিনি বলেন, এই তো কয়েকদিন আগে অফিস থেকে এসে গাড়ি পার্কিংয়ে ঢোকাতেই দেখি অনেক লোক। পরে শুনি একটি বিশাল গোখরা কোথা থেকে যেন আমাদের পার্কিং এরিয়ায় ঢুকে পড়েছে। পরে অ্যানিমেল এসোসিয়েশনে খবর দিলে তাদের লোক এসে সাপটি উদ্ধার করে নিয়ে যায়। শুধু গাড়ির পার্কিংয়ে নয়, বিল্ডিংয়ের ৯/১০ তলাতেও উঠে যাচ্ছে বিষধর সাপ। আমাদের পাশের একটি ভবনের পঞ্চমতলা থেকে এর আগে দু’টি সাপ উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি কখন কোথা থেকে সাপ বের হয়ে আসে। ইকবাল নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, কয়েকদিন আগে আমি আমার বাচ্চাকে নিয়ে প্লে গ্রাউন্ডে নিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি প্লে-গ্রাউন্ডের মাঝে কাগজের নিচে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। পরে আমি তখন পাশের আরেকটা লোককে ডাক দিলাম। সে এসে একটা লাঠি দিয়ে কাগজ সরাতেই দেখি- বড় একটা কালো সাপ ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে। আশপাশের লোকজন তখন ভয়ে দৌড় দেয়। আমরাও খুব ভয় পেয়েছিলাম। কেউ কেউ তখন লাঠি দিয়ে সাপটিকে মারতে উদ্যত হয়। তখন অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ারের লোককে খবর দিলে তারা এসে সাপটিকে ব্যাগে ভরে নিয়ে যায়। আমাদের এখানে অনেক বড় লেক (জলাশয়) রয়েছে। এ ছাড়াও আশপাশে ঝোপ-জঙ্গল আছে। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার ফ্ল্যাটের কাজ চলছে। এসব কারণেই এখানে সাপের উপদ্রব বেশি দেখা যাচ্ছে। এদিকে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের একটি বাড়ির ফ্লোর ভেঙে ২টি বিষধর গোখরা, ৭টি বাচ্চা ও ১৮টি সাপের ডিম উদ্ধার করা হয়েছে। সাপের ভয়ে বাড়ির ভাড়াটিয়ারা বাসা ছেড়ে পালিয়েছে। ওই এলাকার বাসিন্দা মিরাজ হোসেন বলেন, আমাদের মতো এমন জনবহুল এলাকায় এমন বিষধর সাপের কথা চিন্তাই করা যায় না। এরপরও ৪/৫ দিন আগে আমাদের পাশের একটি বাসা থেকে ছোট-বড় দিয়ে ৯টা সাপ উদ্ধার করা হয়েছে। সঙ্গে আরও বিপুল পরিমাণ ডিমও ছিল। আমরা সকলেই ভয়ে আছি। তিনি বলেন, আমার প্রতিবেশী প্রায়ই বলে যে, তার ঘরের আশপাশে সাপ দেখেছে সে। আমরা প্রথমে বিশ্বাস করিনি। পরে আমিও একদিন দেখি একসঙ্গে দুইটা কালো গোখরা। তিনি বলেন, আমাদের খিলগাঁওয়ের কবরস্থানের পেছনে, চৌধুরী পাড়াসহ বেশ কয়েকটি জলাশয় রয়েছে। তবে এমন সাপের উপদ্রব কখনোই আমরা দেখিনি।

এদিকে সাপ আতঙ্ক বিরাজ করছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বসিলাসহ এর আশপাশের এলাকার মানুষের মধ্যেও। বসিলা গার্ডেন সিটি, বসিলা ওয়েস্ট ধানমণ্ডি, মেট্রো হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ওয়াশপুর, ঘাটারচরসহ আশপাশের এলাকায় নিত্যদিনই দেখা মিলছে বিষধর সাপের। মো. হাসান নামে বসিলার এক বাসিন্দা বলেন, আমাদের এলাকায় ৯ তলা বাসা থেকেও ৩/৪টি সাপ উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা তো বৌ-বাচ্চা নিয়ে ভয়ে থাকি। বসিলার মতোই রাজধানীর আরেক নতুন আবাসন গড়ে উঠেছে আফতাব নগর, বনশ্রী ও মেরাদিয়া এলাকায়। এসব এলাকাতেও সাপ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে মানুষ। আফতাব নগরের বাসিন্দা সোহরাব হোসেন পলাশ বলেন, আগে যেই ঝোপ-জঙ্গল ও বড় বড় ঘাস ছিল এখানে তাতে করে সাপ তো থাকবেই। আসল বিষয়টি হচ্ছে- অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য আমরাই সাপসহ অন্যান্য প্রাণিকূলের আবাসস্থল ধ্বংস করে ফেলছি। তাই তারা বাধ্য হয়ে আমাদের বাসা বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। তবে এসব বিষধর সাপের কামড়ে যেকোনো সময়ে মৃত্যু হতে পারে মানুষের। 

এ বিষয়ে  বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক আদনান আজাদ বলেন, গত চার মাসে আমরা শুধু ঢাকা সিটি থেকেই ৩৫১টি সাপ উদ্ধার করেছি। এর মধ্যে মাত্র তিনটি বাদে বাকি সবগুলো পদ্মগোখরা, রাসেল ভাইপার, খৈয়া গোখরা ও রাজ কেউটের মতো মারাত্মক বিষধর সাপ। তিনি বলেন, আমরা সবচেয়ে বেশি সাপ উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের রাজউক ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করেছি। সেখানকার ১১টি ভবনের ৭ তলা, ৯ তলা, গাড়ির পার্কিংসহ বিভিন্ন ফ্ল্যাট থেকে এসব সাপ উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর বনশ্রী, খিলগাঁও ও আফতাবনগরে সাপের উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, যেসব উঁচু ভবন থেকে আমরা সাপ উদ্ধার করেছি তার আশপাশে কোনো না কোনো গাছ ছিল। সেই গাছগুলো বেয়েই হয়তো সাপগুলো ভবনের উপরে উঠেছে। আজাদ বলেন, শুধু খিলগাঁওয়ের একটি বাসা থেকেই কয়েকদিন আগে ছোট-বড় মোট ৩৮টি পদ্মগোখরা সাপ উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে সাপের ডিমও ছিল। আরেক বাসা থেকে এক ডজনের বেশি বাচ্চা সাপ উদ্ধার করছি। আগস্টে খৈয়া গোখরার প্রজননকাল ছিল। তখন এক বাসা থেকেই মা সাপসহ ২৭টি বাচ্চা উদ্ধার করেছিলাম। তিনি বলেন, সাধারণত বর্ষাকালে বৃষ্টির কারণে গর্তে পানি ঢুকে গেলে সাপ শুকনো আশ্রয়ের খোঁজে বাসাবাড়িতে চলে আসে। আবার আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তাদের প্রজননকাল হওয়ায় এই সময় সাপের সংখ্যা বেশি দেখা যায়। আবার আমাদের বাসাবাড়িতে ময়লার ঝুড়িসহ যত্রতত্র ছিটিয়ে রাখা খাবারের লোভেও সাপ চলে আসে। আর আমাদের ভবনের ইঁদুর হচ্ছে সাপের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। তাই এই বিষয়ে রাজধানী বাসিকে আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন এই সাপ বিশেষজ্ঞ।     

সাপের উপদ্রবের বিষয়ে বাংলাদেশ বনবিভাগের ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের ইন্সপেক্টর আব্দুল্লাহ আস সাদিক বলেন, ঢাকায় সাপের উপদ্রবের কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে যেই সংগঠনটির কথা আপনারা বলছেন বা অন্য কোনো সংগঠন কেউই আমাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো অনুমতি নেয়নি। এরপরও আমরা এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা  নেবো।