Image description

আপাতত শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় থাকা ছয় সন্ত্রাসী ও তাঁদের অনুসারীরা চট্টগ্রামের অপরাধজগৎ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব সন্ত্রাসীর প্রকাশ্য বা গোপন নির্দেশে বিভিন্ন বাহিনী দল-উপদলে ভাগ হয়ে হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এসব বাহিনীর আতঙ্কে কাঁপছে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, হাটহাজারী, রাউজানসহ বিভিন্ন এলাকা। ঘটছে একের পর এক খুনের ঘটনা।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাঁপানো ছয় সন্ত্রাসী হচ্ছেন সাজ্জাদ আলী (বড় সাজ্জাদ), সাজ্জাদ হোসেন (ছোট সাজ্জাদ), রায়হান আলম, মোবারক হোসেন ইমন, শহিদুল ইসলাম বুইস্যা ও ইসমাইল হোসেন টেম্পু।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ মাসে রাজনৈতিক বিরোধে চট্টগ্রামে খুন হয়েছে ১৫ জন। গত বুধবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মহানগরের চালিতাতলীতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। ওই হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা।

পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে একই এলাকায় অটোরিকশাচালক ইদ্রিস আলী হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হন। বুধবার সন্ধ্যায় চালিতাতলীতে হামলার পর রাত ১২টায় চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার বাগোয়ানে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়। এভাবেই চলছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। তাতে চট্টগ্রামজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

ছয় সন্ত্রাসী : পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সালে বিদেশে পালিয়ে যান বড় সাজ্জাদ। সেখান থেকেই চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ কমপক্ষে ১২টি মামলা রয়েছে।

গত ১৫ মার্চ ছোট সাজ্জাদকে পুলিশ ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে। এর পর থেকে তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।

স্থানীয় বাকলিয়ার ডাবল মার্ডার, বাবলাসহ ৯টি হত্যাসহ কমপক্ষে ১৬ মামলার আসামি রায়হান আলম। ৯টি হত্যাকাণ্ডসহ আরো মামলা রয়েছে মোবারক হোসেন ইমনের বিরুদ্ধে। এই রায়হান ও ইমন বড় সাজ্জাদ ও ছোট সাজ্জাদের হয়ে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। ইসমাইল হোসেন টেম্পু জেলে রয়েছেন। শহীদুল ইসলাম বুইস্যার নামে রয়েছে ২০টি মামলা। পুলিশ বুইস্যাকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ কালের কণ্ঠকে বলেন, সন্ত্রাসীরা ঘটনা ঘটিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় পালিয়ে যায়। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে এদের যোগাযোগ আছে। পাহাড়ের গহিনে ওরা আত্মগোপন করে থাকে। সেখান থেকে বের হয়ে এসে ঘটনা ঘটিয়ে আবার মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায়। কয়েকটি খুনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখলামতারা মোটরসাইকেল নিয়ে মিশনে আসে। পাহাড়েও অভিযান চালিয়েছি। সেখানে গিয়ে তাদের খোঁজ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার।

ভারতে বড় সাজ্জাদ : পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ২ জুন পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর লিয়াকত আলী খানকে বাড়ির সামনে খুন করে ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হন বড় সাজ্জাদ। তাঁর বিরুদ্ধে খুন, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। ২০০০ সালের ৩ অক্টোবর বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলীতে একে-৪৭ রাইফেলসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে ২০০৪ সালে জামিনে বের হয়ে পালিয়ে বিদেশে যান। কিছুদিন দুবাই অবস্থান করার পর ভারতে অবস্থান নেন। এখনো সে দেশেই আছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। ভারতে অবস্থান করেও তিনি চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশে অপরাধ পরিচালনা করছেন। গত বুধবার শীর্ষ সন্ত্রাসী বাবলা গুলিতে নিহত হয়েছেন। এই খুনের পেছনে বড় সাজ্জাদের হাত রয়েছে বলে দাবি করেছে নিহত বাবলার পরিবার। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তাও এ তথ্য দিয়েছেন।

ছোট সাজ্জাদ জেলে : বড় সাজ্জাদের হাত ধরে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা ছোট সাজ্জাদ কারাগারে থাকলেও তাঁর বাহিনীর সদস্যরা একের পর এক হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে সক্রিয় রয়েছে। ২০১৯ সালে অস্ত্রসহ ধরা পড়ে অপরাধজগতে আবির্ভাব ঘটে এই ছোট সাজ্জাদের। ছয় বছরের ব্যবধানে ডাবল মার্ডারসহ ছয়টি খুনের মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র, মারামারি, হত্যাচেষ্টার সাতটি ও চাঁদাবাজির একাধিক মামলা রয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রাম কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি। এর পর থেকে বায়েজিদ বোস্তামী, চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ এলাকায় নিজের সাম্রাজ্য আরো বিস্তৃত করেন। প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে নিজে ও তাঁর বাহিনীর সদস্যরা চাঁদাবাজিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ছোট সাজ্জাদের নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জনের দল অপকর্ম অব্যাহত রাখে। এক পর্যায়ে গত বছরের ২৯ আগস্ট কুয়াইশ সড়কে গুলি করে মাসুদ কায়সার ও মোহাম্মদ আনিসকে হত্যা করা হয়। একই বছরের ২১ অক্টোবর শমসেরপাড়ায় প্রকাশ্যে গুলি করে আফতাব উদ্দিন তাহসিনকে (২৬) হত্যা করা হয়। এসব খুনে ছোট সাজ্জাদের নাম উঠে আসে। গত ১৫ মার্চ ছোট সাজ্জাদকে পুলিশ ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। কারাগারে থাকলেও তাঁরই গোপন নির্দেশে অনুসারীরা হত্যাসহ বিভিন্ন অপকর্মে আরো সক্রিয় রয়েছে বলে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

দুই সাজ্জাদের হয়েই সক্রিয় রায়হান : ছোট সাজ্জাদ কারাগারে গেলে অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নেন রায়হান আলম। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, টার্গেট কিলিংয়ে অভ্যস্ত রায়হান। রাউজান, ফটিকছড়ি ও রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি এলাকায় তাঁর রয়েছে গোপন আস্তানা। রায়হান চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার বাসিন্দা। হত্যাচেষ্টার একটি মামলায় কারাগারে গিয়ে ছোট সাজ্জাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। গত বছরের ৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে জামিনে বের হন রায়হান। সূত্র জানায়, ছোট সাজ্জাদের অস্ত্রের ভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণও রয়েছে রায়হানের হাতে। গত বুধবার বাবলাকে মাথার পেছনে অস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যা এবং বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য প্রার্থী এরশাদ উল্লাহকে গুলিবিদ্ধ করার ঘটনায় তিনি সরাসরি জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বাবলা খুনের মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে। বড় সাজ্জাদের নির্দেশে বাবলাকে রায়হান ও তাঁর অনুসারীরা খুন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের রাউজানে গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদলকর্মী মুহাম্মদ আলমগীর আলমকে। পুলিশ জানিয়েছে, ওই হত্যা মামলায়ও রায়হানের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে এসেছে। এটিসহ রাউজানে তাঁর বিরুদ্ধে চারটি হত্যা মামলা আছে।

পুলিশ জানায়, গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর চান্দগাঁওয়ে ইট-বালুর ব্যবসায়ী মো. তাহসীন হত্যায়ও রায়হানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগরীর কুয়াইশে মো. মাসুদ ও মো. আনিছকে গুলি করে হত্যা হয়। ওই মামলার আসামিও রায়হান। গত ২৩ মে চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে সন্ত্রাসী আকবর আলীকে (ঢাকাইয়া আকবর) প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয়। ওই খুনের মামলারও আসামি রায়হান। গত ৩০ মার্চ বাকলিয়া অ্যাকসেস রোডে প্রাইভেট কারে গুলি করে দুজনকে হত্যা করা হয়। বাবলাকে খুনের উদ্দেশ্যে এই হামলা চালানো হয়েছিল। ছোট সাজ্জাদ ও তাঁর স্ত্রী তামান্নাকে বাবলা পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন, এই সন্দেহ থেকে ওই হামলা করা হয়। তবে সেই যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন বাবলা।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) আমিরুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, বাবলা হত্যায় রায়হান ও বড় সাজ্জাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। বড় সাজ্জাদ বিদেশ থেকে বিভিন্ন অপরাধ করে যাচ্ছে। আমরা রায়হানকে গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করছি। একাধিক দল মাঠে কাজ করছে।

এদিকে রায়হানের অপরাধের অন্যতম সঙ্গী ফটিকছড়ির বাসিন্দা মোবারক হোসেন ইমন অভিজ্ঞ শ্যুটার বলে পরিচিতি পেয়েছেন অপরাধজগতে। ইমনও ছোট সাজ্জাদের অনুসারী। গত বুধবার বাবলা কিলিং মিশনেও ইমন উপস্থিত ছিলেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। পুলিশ জানায়, চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে প্রকাশ্যে গোলাগুলি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত রয়েছে শহিদুল ইসলাম বুইস্যা ও ইসমাইল হোসেন টেম্পু ও তাঁদের বাহিনীর অনুসারীরা। টেম্পু কারাগারে আছেন। গত ৪ অক্টোবর পাঁচলাইশে বিজয় চৌধুরীর গ্যারেজের সামনে গুলি ছোড়েন বুইস্যার অনুসারী মুন্না। বুইস্যার দলে অনুসারীর সংখ্যা ৪০ হবে।