ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে বিপাকে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবারের নির্বাচনে গত তিন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনে রাখা হবে না। এমনকি এখনো যাঁরা ডিসি রয়েছেন, তাঁদের তুলে এনে নির্বাচনের আগে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। ডিসি পদে যোগ্য কর্মকর্তা খুঁজে বের করতে গত জুন থেকে উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দফায় বিসিএস ২৮তম ব্যাচের ১৬০ জন কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র ২০ জনকে ডিসির জন্য বাছাই করা হয়েছিল। তাঁদের বেশির ভাগই বিগত নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসারের (এআরও) দায়িত্ব পালন করায় এখনো পদায়ন করা হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি ডিসি নিয়োগ কমিটির কোনো সদস্য।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ২১ জেলায় ডিসি রয়েছেন বিসিএস ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে তিনজন বাদে সবাই গত ফেব্রুয়ারিতে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হয়েছেন। পদোন্নতি পাওয়ার পরও তাঁরা ১০ মাস ধরে ডিসির দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই ব্যাচের সবাইকে মাঠ প্রশাসন থেকে তুলে আনার কথা। এ ছাড়া বিসিএস ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা ডিসি রয়েছেন ২৭ জন। দক্ষতার ঘাটতির কারণে এই ব্যাচের কিছু কর্মকর্তাকে তুলে আনা হবে। অন্য ১৬ জন ডিসি বিসিএস ২৭তম ব্যাচের। নির্বাচনের আগে অন্তত ৩০ জন নতুন ডিসি পদায়ন করার কথা রয়েছে। খুব শিগগির ডিসি পদে রদবদল হতে পারে।
ডিসি নিয়োগে সাক্ষাৎকার নেয় মন্ত্রিপরিষদসচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি। এসংক্রান্ত ‘পদায়ন নীতিমালা’য় বলা হয়েছে, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মচারীদের মধ্য থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার এক বছর পর ডিসি পদে পদায়নের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। ডিসি পদে ‘ফিট লিস্ট’ বা যোগ্য তালিকা তাঁদের নিয়েই করা হবে, যেসব কর্মকর্তার মাঠ প্রশাসনে ন্যূনতম দুই বছর চাকরির অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ ছাড়া একজন কর্মকর্তার আগের পাঁচ বছরের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনের (এসিআর) রেকর্ড এবং চাকরিজীবনের শৃঙ্খলা প্রতিবেদন সন্তোষজনক হতে হবে। সাধারণত উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ডিসি করা হয়।
জানা গেছে, ডিসি পদে যোগ্য কর্মকর্তা খুঁজে বের করতে গত ২৯ অক্টোবর থেকে উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এবারের সাক্ষাৎকারে বিসিএস ২৯তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। ওই দিন রাতে ২০ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এরপর সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ টানা কয়েক দিন সাক্ষাৎকার নিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ২৯তম ব্যাচের মোট ১১০ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে গত জুন ও জুলাই মাসে বিসিএস ২৮তম ব্যাচের ১৬০ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে বিগত নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কাউকে এবার যুক্ত করা হচ্ছে না। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাজ করেননি—এমন কর্মকর্তা প্রশাসনে খুবই কম।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২৮ ও ২৯ ব্যাচের কর্মকর্তারা এখন ডিসি হওয়ার যোগ্য। তবে তাঁদের বেশির ভাগ ২০১৮ সালের নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসার ছিলেন। আবার এই দুই ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন, যাঁদের মাঠ প্রশাসনে ন্যূনতম দুই বছর চাকরির অভিজ্ঞতা নেই। ফলে তাঁরা ডিসি হওয়া থেকে বাদ পড়ছেন। জনপ্রশাসনে ২৮তম ব্যাচের ১৯৬ জন কর্মরত রয়েছেন। ২৯তম ব্যাচের রয়েছেন ১৯৮ জন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ কর্মকর্তার দাবি, মাঠ প্রশাসনে যাঁরা ইউএনও ছিলেন, স্বাভাবিকভাবে তাঁরা সবাই সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। এখানে সরকার কাউকে পছন্দ করে এআরও বানায়নি। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবেই তাঁরা নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। সরকারের দেখা উচিত, কারা অতি উৎসাহী ও দলান্ধ হয়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন এবং তাঁদের বাদ দেওয়া উচিত। এ ছাড়া একটি ব্যাচের একজনকেও ডিসি হিসেবে নিয়মিত পদায়ন না করে পরবর্তী ব্যাচকে ফিটলিস্টের জন্য আহবান জানানো নজিরবিহীন। এতে প্রশাসনের স্বাভাবিক চেইন অব কমান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। সাধারণত প্রতিটি ব্যাচের সদস্য দু-তিনবার ফিটলিস্টের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান।
এ ব্যাপারে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ মো. ফিরোজ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে ক্ষমতাসীন সরকার। তারা যেভাবে নির্দেশনা দেয় মাঠ প্রশাসন সেভাবেই কাজ করে। এখানে ডিসি-ইউএনও কি ভোটকেন্দ্রে ভোট নেন? ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করেন প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার, যাঁদের বেশির ভাগই সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। সরকার কি তাঁদের বাদ দেবে? তাহলে এত লোক কোথায় পাবে? এভাবে প্রশাসনকে বিতর্কিত করা হচ্ছে। এতে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা বাড়বে এবং কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে পড়বে। ডিসি হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হবে, তাঁরাও ভয়ে নিষ্ক্রিয় থাকবেন। সরকার বিষয়টি স্মার্টলি হ্যান্ডল করতে পারছে না।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডিসিরা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে থাকেন। কোনো নির্বাচনী আসনে নির্বাচনের সব দায়িত্ব থাকে রিটার্নিং অফিসারের। তিনিই মূলত সংশ্লিষ্ট আসনে নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিত্ব করেন। এ ক্ষেত্রে ডিসিদের নিরপেক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে জেলায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ক ডিসি। জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটিসহ শতাধিক কমিটির সভাপতি ডিসি। ডিসির জন্য বড় বাংলো থাকে, একাধিক দামি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ থাকে, পুলিশ পাহারা থাকে এবং বাসায় থাকে নিরাপত্তাকর্মী ও রান্নার লোক। ফলে অনেক কর্মকর্তার কাছে এই পদটি আকর্ষণীয়।