Image description
চট্টগ্রামে বাবলা হত্যাকাণ্ড । বড় সাজ্জাদকে প্রধান আসামি করে মামলা । বাবলার মৃত্যু নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা হয় ৭.৬২ বোরের বিদেশি পিস্তল ।

চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর নির্বাচনি প্রচারণায় প্রকাশ্যে গুলি করে সরোয়ার হোসেন বাবলা হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদকে প্রধান আসামি এবং আরও সাতজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১৪-১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় খুনের শিকার সরোয়ার বাবলার বাবা আবদুল কাদের বাদি হয়ে মামলাটি করেন। মামলার এজাহারভুক্ত দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। শুক্রবার ভোরে চান্দগাঁও থানার হাজীরপুল এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। হত্যাকাণ্ডে ‘সরাসরি জড়িত’ আরেকজনকে গ্রেফতার করেছে বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশ। বাবলার মৃত্যু নিশ্চিত করতে ঘাতকরা ব্যবহার করে ৭.৬২ বোরের বিদেশি পিস্তল। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চট্টগ্রাম-৮ আসনের প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। খুনের ঘটনায় কারা জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। হত্যার মিশনে অংশ নেওয়া চারজনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন তারা।

বুধবার সন্ধ্যায় বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলী এলাকায় বিএনপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগকালে বাবলাকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে নিহতের বাবা আবদুল কাদের বাদী হয়ে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় মামলা করেন। মামলায় বিদেশে পলাতক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদ এবং তার বাহিনীর কিলিং স্কোয়াডের প্রধান হিসাবে পরিচিত রায়হান আলমসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলো-বোরহান উদ্দিন, নেজাম উদ্দিন, আলাউদ্দিন, মোবারক হোসেন ওরফে ইমন ও হেলাল ওরফে মাছ হেলাল। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী বড় সাজ্জাদ বা সাজ্জাদ আলীকে। মামলার এজাহারে বড় সাজ্জাদকে মূলহোতা বা পরিকল্পনাকারী (মাস্টারমাইন্ড) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সরোয়ার বাবলা কিলিং মিশনে জড়িত চারজনের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত হয়েছে। তারা হলো পূর্ব রাউজানের বদিউল আলমের ছেলে রায়হান (৩৫), ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর গ্রামের মোহাম্মদ মুসার ছেলে মোবারক হোসেন ইমন (২২), নগরীর খুলশী সিডিএ পুনর্বাসন এলাকার খায়রুল আলমের ছেলে বোরহান (২৭) ও রাউজানের পরীর দিঘির পাড় এলাকার আনোয়ার হোসেনের ছেলে মো. খোরশেদ (৪৫)। বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি জসিম উদ্দিন যুগান্তরকে হত্যা মামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

নিহতের পরিবার ও পুলিশের দাবি, বড় সাজ্জাদের পরিকল্পনায় চট্টগ্রাম নগরীতে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। দুই যুগ ধরে বিদেশে বসে চট্টগ্রামের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী বড় সাজ্জাদ। একসময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় বড় সাজ্জাদ ‘শিবির ক্যাডার’ হিসাবে পরিচিত। নগরীর পাঁচলাইশ, বায়েজিদ বোস্তামী, বাকলিয়া, চকবাজার এলাকা থেকে জেলার হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় তার পরিকল্পনায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলছে। তার নির্দেশে অপকর্মের মধ্যে মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি, বালুমহাল-ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ভবন নির্মাণে ইট-বালুসহ নির্মাণসামগ্রী সরবরাহে প্রভাব বিস্তার এবং রাজনৈতিক আধিপত্য-সবই ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। বড় সাজ্জাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল ছোট সাজ্জাদ। গত ১৫ মার্চ পুলিশ ঢাকা থেকে সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদকে গ্রেফতার করে। এরপর থেকে সে কারাগারে রয়েছে। এখন বড় সাজ্জাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে কাজ করছে রায়হান। রায়হানের বিরুদ্ধে ১৪ মাসে ৯টি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তারপরও তাকে গ্রেফতার করতে পারছে না পুলিশ।

মৃত্যু নিশ্চিত করতে ৭.৬২ পিস্তল দিয়ে গুলি : সরোয়ার হোসেন বাবলার মৃত্যু নিশ্চিত করতে ঘাতকরা বিদেশি ৭.৬২ বোরের পিস্তল ব্যবহার করে। তাও আবার খুব কাছ থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, সরোয়ারকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে। অস্ত্রের আকার ও আঘাত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এটি শক্তিশালী ৭.৬২ বোর পিস্তলের গুলি। এটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। প্রথম তিনটি গুলির পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বাবলা। পরে আরও কয়েক রাউন্ড গুলি করে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে খুনিরা।

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলন : বায়েজিদ বোস্তামী থানায় মামলা করার পরপরই র‌্যাব অভিযানে নামে। বৃহস্পতিবার ভোরে চান্দগাঁও থানার হাজীপুল এলাকায় অভিযান চালিয়ে এজাহারভুক্ত দুই আসামিকে গ্রেফতার করে। তারা হচ্ছেন আলাউদ্দিন ও হেলাল উদ্দিন। তাদের গ্রেফতারের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানাতে শুক্রবার দুপুরে র‌্যাব-৭ এর চান্দগাঁও ক্যাম্পে এক সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাব। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাফিজুর রহমান বলেন, গ্রেফতার দুজন র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে। তবে সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলীসহ মামলার অন্য আসামিদের সঙ্গে চলাফেরা রয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য জানতে রিমান্ডের প্রয়োজন রয়েছে।

এদিকে র‌্যাব কার্যালয়ের সামনে আলাউদ্দিনের বড় ভাই মনজুর আলম যুগান্তরকে বলেন, আলাউদ্দিন যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। শুক্রবার সকালে তাকে বাসা থেকে র‌্যাব সদস্যরা গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছেন। সে এরশাদ উল্লাহর প্রচারণায় কেন গুলি করবে। তার সঙ্গে বাবলার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। একই কথা বলেন মনজুরের সঙ্গে থাকা আলাউদ্দিনের স্ত্রী দোলা আক্তার। তিনি বলেন, আমার স্বামী ব্যবসা করেন। কোনো খারাপ কাজে জড়িন নন।

পুলিশের হাতে গ্রেফতার এক : বাবলা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত একজনকে গ্রেফতার করেছে বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশ। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে অক্সিজেন এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানা গেছে। তবে তার নাম মামলার এজাহারে উল্লেখ নেই। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি জসিম উদ্দিন। তিনি যুগান্তরকে জানান, বাবলা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে তার নাম এজাহারে নেই। তবে তদন্ত তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

আহত এরশাদ উল্লাহকে ঢাকায় প্রেরণ : গণসংযোগ চলাকালে চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী গুলিবিদ্ধ এরশাদ উল্লাহকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে তাকে হেলিকপ্টারযোগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান। তিনি বলেন, এরশাদ উল্লাহ ভাই বুকের ডান পাশে ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এখন তিনি শঙ্কামুক্ত। পরিবারের সদস্যরা এবং আত্মীয়স্বজন আলোচনা করে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উনাকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।