Image description
চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেস সড়ক

বছরের পর বছর চলছে গত আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো। ব্যয় বাড়িয়ে এসব প্রকল্পের ঘানি টানছে দেশ। প্রকল্প বাস্তবায়ন দীর্ঘায়িত হওয়ায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে আবারো ব্যয় বাড়ছে। নকশায় ফের পরিবর্তনে র‌্যাম্পের কারণে খরচও বাড়ছে। এই নিয়ে মোট এক হাজার ৬৫ কোটি টাকা খরচ বাড়বে। আর তিন বছরের এই প্রকল্পটি এখন আট বছরে উন্নীত হচ্ছে। কাজের অগ্রগতি গত আগস্ট পর্যন্ত ৯১ শতাংশ কাজ হয়েছে। ১৪টি র‌্যাম্পের মধ্যে ৯টি র‌্যাম্পের কাজ ইউটিলিটি সিফটিং, ভূমি ক্রয়ের জটিলতা এবং গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে এখনো শুরু করা সম্ভব হয়নি। এদিকে পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, প্রকল্পের কাজ খুবই হতাশাজনক। আগামী ৩০ জানুয়ারি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটিতে এটি নিয়ে আলোচনা হবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে নগরের লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সিডিএর ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয় ২০১৭ সালের আগস্টে। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। এখন প্রকল্প ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। এটির নামকরণ করা হয় মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে। সরকার পতনের পর গত বছরের ২৮ আগস্ট থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে পরীক্ষামূলক যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে।

প্রকল্পটির সংশোধন নিয়ে প্রকল্প পরিচালক পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনার তথ্য থেকে জানা গেছে, মোট ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জুলাই-২০১৭ হতে জুন-২০২০ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ প্রথম দফায় জুন-২০২২ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। সরেজমিন কাজ শুরু করার পর পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রকল্পের ১ম সংশোধিতে খরচ মোট ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ ১১ হাজার টাকা এবং জুলাই ২০১৭ হতে জুন ২০২৪ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য গত ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। এরপর প্রকল্পের অনুমোদিত ১ম সংশোধিত ডিপিপির মূল ব্যয় ঠিক রেখে আন্তঃখাত সমন্বয়ের প্রস্তাব গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় হতে গত ২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর প্রশাসনিক অনুমোদন লাভ করে। বর্তমানে প্রকল্পের আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত প্রকল্পটির খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৭৬২ কোটি ২০ লাখ ৯৪ হাজার টাকা (৮৭.৫১ শতাংশ) এবং বাস্তব অগ্রগতি ৯১ শতাংশ।

 

জানা গেছে, প্রকল্পের শুরু থেকে অদ্যাবধি ভূমি ক্রয় খাতে ১০২ কোটি টাকা সরকার হতে ছাড় করে খরচ করা হয়েছে। বাকি টাকা চউকের নিজস্ব অর্থায়নে ব্যয় করার সংস্থান রাখা হয়েছে। যা টোল আদায়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক ও ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করা হবে। ভূমি ক্রয় ও স্থাপনার ক্ষতিপূরণ খাতে ব্যয় হ্রাস পাওয়ায় এবং ভূমি ক্রয় ও স্থাপনার ক্ষতিপূরণ অঙ্গে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হতে নিজস্ব অর্থায়নে ৪৭ কোটি ৯৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ব্যয় করার প্রস্তাব করায় ডিপিপি সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
নতুন খাত ও ব্যয় বৃদ্ধি : বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং চট্টগ্রাম বন্দরের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ওই দু’টি সংস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বারেক বিল্ডিং হতে সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায় ১.৫০ কিমি দীর্ঘ ও ২.৫৪ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট নিরাপত্তা প্রতিবন্ধক নির্মাণ করতে হবে। বাওয়া স্কুল ও বারিকবিল্ডিং এলাকায় রাস্তার পার্শ্ববর্তী বিল্ডিংগুলো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কাছে হওয়ায় শব্দদূষণ রোধকল্পে শব্দ প্রতিবন্ধক নির্মাণের কাজ নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে প্রকল্পের ব্যয় ১১ কোটি ৭৩ লাখ ৬৩ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। রোড মার্কিং অঙ্গে রাত্রিকালীন সময়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২য় সংশোধিত ডিপিপিতে নতুন কিছু কাজ সংস্থান রাখা হয়েছে। এতে রোড মার্কিং অঙ্গে ৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ড্রেন খাতে কাজ বৃদ্ধিতে খরচ বাড়ছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও র‌্যাম্পের অ্যালাইনমেন্টের দুই পাশে ভূমি ক্রয় করার ফলে ওই স্থানে নতুন ড্রেন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন অনুযায়ী আরসিসি ড্রেনের দৈর্ঘ্য ৬৬৬ মিটার হতে ৪৬৮ মিটার বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ১৩৪ মিটারে এবং ব্রিক ড্রেনের দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৯২১ মিটার হতে ৩ হাজার ২৬ মিটার বৃদ্ধি পেয়ে ৬ হাজার ৯৪৭ মিটারে উন্নীত হয়েছে। এতে প্রকল্পের ড্রেন অঙ্গে ৫ কোটি ৬০ লাখ ১৩ হাজার টাকাসহ মোট ১২ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।

র‌্যাম্পের কারণে সংশোধন : প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসেবে বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পের অনুমোদিত ১ম সংশোষিত ডিপিপিতে সর্বমোট ১৪টি র‌্যাম্প নির্মাণের সংস্থান ছিল। কিন্তু সাইটের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জিইসি থেকে বিমানবন্দরমুখী উপরে উঠার র‌্যাম্প, আগ্রাবাদ হতে এক্সেস রোডের দিকে ওঠা ও নামার র‌্যাম্প, নিমতলা মোড়ে ওঠা ও নামার র‌্যাম্প, সিইপিজেড এলাকার ওঠা ও নামার র‌্যাম্পগুলোর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সিমেন্টক্রসিং মোড়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী নৌবাহিনীর নিজস্ব জায়গায় একটি নতুন র‌্যাম্প সংযোজনের প্রস্তাব করায় সামগ্রিকভাবে র‌্যাম্পের দৈর্ঘ্য ১ম সংশোধিত নির্ধারিত ৫ হাজার ৬৪ মিটার হতে এক হাজার ১৫৬ মিটার বৃদ্ধি পেয়ে ৬ হাজার ২২০ মিটারে উন্নীত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া প্রতিটি র‌্যাম্পের পিয়ার পয়েন্টে মাটি পরীক্ষা সম্পন্ন করায় মাটির অবস্থা খারাপ থাকার কারণে পাইলিংয়ের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। র‌্যাম্প নির্মাণের অ্যালাইনমেন্টের মধ্যে চট্টগ্রাম ওয়াসা, বিটিসিএল ও কেজিটিসিএলের ভূগর্ভস্থ ইউটিলিটি লাইন থাকার কারণে ফাউন্ডেশনের ডিজাইনে কিছুটা পরিবর্তন হওয়ায় প্রকল্প সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পের অনুমোদিত ১৪টি র‌্যাম্পের মধ্যে ৫টি র‌্যাম্পের কাজ চলমান রয়েছে। বাকি ৯টি র‌্যাম্পের কাজ এখনো শুরু করা সম্ভব হয়নি।

বাস্তবায়নকাল বৃদ্ধি : র‌্যাম্পগুলোর অ্যালাইনমেন্টের মধ্যে স্থিত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ৩৩/১১/০.৪ কেডি বৈদ্যুতিক লাইন, পোল, ওভারহেড, উচ্চ ভোস্টেজ ওভারপাস বা রোড ক্রসিং লাইন এবং কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ভূগর্ভস্থ গ্যাস পাইপলাইন স্থানান্তর এবং র‌্যাম্পগুলোর অ্যালাইনমেন্ট অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জায়গা ক্রয় এবং স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম সময় সাপেক্ষ বিধায় র‌্যাম্পগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বর-২০২৫ পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বলছে, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হয় জুলাই ২০১৭। ইতোমধ্যে ৭ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এই ৭ বছরে প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৮৭.৫১ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৯১ শতাংশ। প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ ডিসেম্বর ২০২৫ প্রস্তাব করা হয়েছে তা কতটা যৌক্তিক এবং প্রস্তাবিত মেয়াদে প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তারা বলছেন, বিভিন্ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন অনুযায়ী কতটা বাস্তবসম্মত তা পিইসি সভায় আলোচনা করা হবে।

প্রকল্প পরিচালকের কথা : প্রকল্পের ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী (প্রকল্প) মো: মাহফুজুর রহমানের সাথে গতকাল মোবাইলে কথা হলে তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের দিকে। আমাদের আন্তঃখাত সমন্বয় দরকার। এ ছাড়া ভূমি অধিগ্রহণের কিছু টাকা সমন্বয় করা প্রয়োজন। সেটা সরকার দিচ্ছে না। আমাদেরকেই দিতে হচ্ছে। কিছু র‌্যাম্পের দৈর্ঘ্য বেড়েছে। তিনি বলেন, কিছু নিরাপত্তা এলাকা করতে হচ্ছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফ্লাইওভার এলাকাতে কিছু কাজ করতে হচ্ছে। রাস্তায় কিছু ডিজিটাল নির্দেশক দিতে হচ্ছে। রোড মার্কিং করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ঠিকাদারের সাথে যে চুক্তি ছিল সেখানে মূল্য সমন্বয় করতে হচ্ছে। ডিপিপিটা যখন সংশোধন করা হয় তখন ছিল ২০২১ সাল। তখন থেকে এখন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এখানে ঠিকাদারের রেট বাড়বে না। নির্মাণসামগ্রীর দাম পুনর্নির্ধারণ করা হবে।