Image description
উভয় দলের নেতাকর্মীরা মিলেমিশে করছেন অবৈধ বালুর ব্যবসা -অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের

বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার যমুনা ও বাঙালি নদীর বিভিন্ন বালুমহাল আগে আওয়ামী লীগের নেতারা ইজারা নিয়ে ভোগ করলেও এখন সেসব বিএনপির কবজায়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের লোকজন বালুমহালগুলো দখল করেছেন। তবে গোপনে ইজারাদার আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের লোকজনকে ভাগ দিচ্ছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এ কারণে বালুর অবৈধ ব্যবসা নিয়ে এলাকায় প্রকাশ্যে কোনো আলোচনা নেই। পলাতক থাকায় ইজারাদার আওয়ামী লীগের লোকজনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ধুনট : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের চৌবেড় মৌজায় সরকারি বালুমহালটি গত কয়েক বছর ধরে ইজারা পান জেলা যুবলীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক বেলাল হোসেন। তার সঙ্গে থেকে স্থানীয় নেতাকর্মীরা পার্শ্ববর্তী সারিয়াকান্দি উপজেলার বোহাইল, আওলাকান্দি, ধুনটের শহরাবাড়ি, শিমুলবাড়ি, ভান্ডারবাড়ি, বৈশাখী, কৈয়াগাড়ি ও ভূতবাড়ি এলাকায় যমুনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করেন। এসব বালু ট্রাকে পরিবহণ করে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়। শহরাবাড়ি ঘাট থেকে অতিরিক্ত বালু পরিবহণ করায় কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ধুনট উপজেলা পর্যন্ত সড়ক চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মামলা, হামলা ও গ্রেফতার শুরু হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপন করেন। এ সুযোগে বালুমহাল নিয়ন্ত্রণে নেন স্থানীয় বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। তাদের অন্যতম হলেন ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম, উপজেলা যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক রাশেদুজ্জামান উজ্জ্বল ও ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, উপজেলা বিএনপির সদস্য বেলাল হোসেন বাবু। তারা ইজারাদার যুবলীগ নেতা বেলাল হোসেনকে মামলায় না জড়ানো ও হয়রানি না করার শর্তে বালু উত্তোলন ও বিক্রি শুরু করেন। অবশ্য বিক্রির একটা অংশ বেলালকেও দেওয়া হচ্ছে। অবাধে বালু তোলায় শহরাবাড়ি খেয়াঘাটের পাশের চর ও শিমুলবাড়িতে জেগে ওঠা চর যমুনা নদীতে বিলীন হয়েছে। আবার বৈশাখী চরের অবস্থাও বেহাল।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি কোনো বালুমহাল দখলে নেননি। দলের অন্য কেউ এ কাজে জড়িত থাকতে পারেন।

এছাড়া বাঙালি নদীতে নাব্য ফেরাতে বালু উত্তোলন করে পেঁচিবাড়ি এলাকায় স্তূপ করা হয়েছিল। আগে আওয়ামী লীগ নেতা বুল্টন মেম্বর গোপনে ওই বালু বিক্রি করতেন। পরবর্তীতে উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহীন রাতের আঁধারে বালু দখল করে নেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, সাবেক এক এমপির নাম ভেঙে ধুনট পৌর বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার নেতৃত্বে বালুর ব্যবসা চলছে।

সারিয়াকান্দি : পূর্ব বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় পাঁচটি বালুমহাল রয়েছে। এর মধ্যে কর্ণিবাড়ি ইউনিয়নের নারাপালা ও বোহাইল ইউনিয়নের কালিয়ান সবচেয়ে বড়। উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আইয়ুব আলী তরফদার ও সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম কয়েক বছর আগে থেকে নারাপালা বালুমহাল ইজারা নিয়ে আসছেন। আর কালিয়ান বালুমহাল ইজারা নিতেন জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও কামালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাশেদুজ্জামান রাসেল। সাব-লিজ নেন হাটশেরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইফাজ উদ্দিন প্রামাণিক। এরাই দীর্ঘদিন সারিয়াকান্দি উপজেলায় বৈধ ও অবৈধ বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। গত ৫ আগস্টের পর ইজারাদার আওয়ামী লীগের নেতারা এলাকাছাড়া হন। এরপর তাদের বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক রাজু আলম, কামালপুর ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন পুটু, স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানা ও বিএনপি কর্মী মোখলেছার রহমান হিটলু। তারা বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিলেও গোপন অলিখিত চুক্তিতে সঙ্গে রাখেন আওয়ামী লীগের ওই তিন নেতাসহ কয়েকজনকে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে ফসলি জমি নদীতে বিলীন হওয়ার প্রতিবাদ করায় ব্যবসায়ীরা গত ৮ জানুয়ারি ইছামারার মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলমকে মারধর করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিএনপি নেতাদের বালুমহালগুলো দখল প্রসঙ্গে সারিয়াকান্দি পৌর বিএনপির সভাপতি শাহাদৎ হোসেন সনি সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগসাজশে বিএনপির অঙ্গসংগঠনের বেশ কয়েকজন বালু ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তাদের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন নেতাদের জানানো হবে। উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক রাজু আলম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি বালু ব্যবসায় জড়িত নন। তবে মোখলেছার রহমান হিটলুসহ কয়েকজন জড়িত।

উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরে আজম বাবু বলেন, তাদের দলের যারা বালু ব্যবসায় জড়িত ছিল, তারা এখন আর নেই। আওয়ামী লীগের লোকজন এখনো গোপনে বালু ব্যবসা করছেন।

সোনাতলা : অপরদিকে সোনাতলা উপজেলায় প্রায় আটটি বালুমহাল রয়েছে। এর মধ্যে মধুপুর বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতেন মধুপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল করিম রেজা, সোনাকানিয়া বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার রহমান শান্ত ও সর্জনপাড়ার বালুমহাল নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সোনাতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাদুজ্জামান লিটন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বালুমহালগুলো বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতা ও তাদের লোকজন দখল করে নিয়েছেন। এখন বালুমহালগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম টিটো, মধুপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান প্রিন্স, জোড়গাছা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি গোলাম রব্বানী, উপজেলা বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম প্রমুখ।

বালুমহাল দখল ও ব্যবসার অভিযোগ প্রসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম টিটু বলেন, তিনি কখনো বালুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন। প্রতিপক্ষের লোকজন তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছেন।

বগুড়ায় বিভিন্ন পয়েন্টে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসন হোসনা আফরোজা সাংবাদিকদের বলেন, যমুনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বিষয়ে প্রশাসনের সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছে। অভিযোগ পেলে সেখানে অভিযান চালানো হবে।