Image description
♦ ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধের পর থেকে পদ্মার চেহারা পাল্টাতে থাকে ♦ ৪০ বছরে আয়তন নেমেছে অর্ধেকে, কমেছে প্রবাহ ♦ বিলুপ্তির পথে দেশি মাছ, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য

উত্তরের চার জেলায় নদীর জমি দখল করেছেন ৪ হাজার ২৩১ জন। পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব দখলদারের তালিকা করেছে। কিন্তু উচ্ছেদ অভিযান চালাতে পারেনি। দখলদারের তালিকায় আছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা নেতা-কর্মী। দখলদারের তালিকায় নাম আছে সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেরও।

তালিকা অনুযায়ী, রাজশাহী ৬০০, নওগাঁয় ২ হাজার ৯২৫, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৬১ ও নাটোরে ৪৪৫ জন দখল করে আছেন নদীর জমি। পদ্মা, মহানন্দা, আত্রাই, বারনই ও নারোদ নদী দখল করে নানা স্থাপনা গড়ে তুলেছেন তারা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অঙ্কুর বলেন, তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকা জেলা প্রশাসককে দেওয়া হয়েছে। এখন জেলা প্রশাসক উচ্ছেদ অভিযান চালাবেন। জেলা প্রশাসক আফিয়া আকতার জানান, শিগগিরই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

প্রমত্তা পদ্মা এখন মরতে বসেছে। ৪০ বছরে আয়তন নেমেছে অর্ধেকে। কমেছে পানির গভীরতা ও প্রবাহ। বিলুপ্তির পথে মাছ। হুমকিতে জীববৈচিত্র্য। ¯িপ্রংগার থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড কনজারভেশন ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় উঠে আসা গবেষণার তথ্যে বলা হয়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মার আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। মিঠা পানির সরবরাহ সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। ১৯৮১ সালে তাপমাত্রা ছিল ২৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ২ ডিগ্রিতে। পদ্মার প্রকৃত অবস্থা বুঝতে গবেষণার জন্য শুকনো মৌসুমকে বেছে নেওয়া হয় বলে জানান গবেষকরা।

শুকিয়ে যাচ্ছে প্রমত্তা পদ্মা

গবেষক দলের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামস মুহা. গালিব বলেন, আমরা ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পদ্মার হাইড্রোলজিক্যাল, জলবায়ু ও নৃতাত্ত্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে মৎস্য প্রজাতির সম্পর্কের প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করছিলাম। দেখা গেছে, পদ্মার আয়তন বর্তমানে অর্ধেক কমে গেছে। এর প্রভাবে জীববৈচিত্র্যে প্রভাব পড়েছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চারঘাটের সরদহ পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটার অংশ নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। ওই এলাকার নয়টি পয়েন্টে মৎস্য প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পদ্মাপাড়ের ২৭টি জেলেপল্লী থেকে নেওয়া হয় তথ্য। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে পদ্মার বর্তমান চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেছে গবেষক দল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মার চেহারা পাল্টাতে থাকে ১৯৭৫ সালের পর থেকে। ওই বছর পদ্মার ১৮ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ভারত। এ বাঁধ দিয়ে ভাগীরথী ও হুগলি নদীতে পানি প্রত্যাহার শুরু করে প্রতিবেশী দেশটি। এর প্রভাবে পানি কমতে শুরু করে পদ্মায়। গবেষকরা জানান, ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহ ছিল ৯ হাজার ৩২ ঘনমিটার। চালুর পর ১৯৭৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রবাহ নেমেছে ৫ হাজার ১৪৬ ঘনমিটারে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ১৯৭৫ সালে চালু হয় ফারাক্কা বাঁধ। ১৯৭৭ সালে ভারতের সঙ্গে প্রথম গঙ্গার পানি চুক্তি সই হয়। সঙ্গে যুক্ত ছিল গ্যারান্টি ক্লজ। সামরিক সরকার এরশাদের আমলে এ চুক্তি দুবার নবায়ন হয়। ১৯৮২ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে একই বছর সমঝোতা স্মারক সই হয়। তবে বাদ দেওয়া হয় গ্যারান্টি ক্লজ। যেখানে ছিল বাংলাদেশের হিস্যার ৮০ শতাংশ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা। সবশেষ ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি হয়। তাতেও রাখা হয়নি গ্যারান্টি ক্লজ। চুক্তি অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ১০ দিন পরপর ৩৫ হাজার কিউসেক পানি উভয় দেশ পাবে। পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে উল্লেখ করে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, সংকটের শেকড় অনেক গভীরে। মোকাবিলায় অববাহিকাভিত্তিক বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালকে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।