শেখ হাসিনার শাসনামলে বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ন্যায়বিচার এবং তাদের প্রয়োজনীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন বলে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান ও পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা বারবার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল; আইনি কর্তৃপক্ষ গুমের অভিযোগ তদন্ত বা সত্য উদঘাটনে সামান্যতম তৎপরতা দেখায়নি। অভিযোগ নথিভুক্ত করতে বা যথাযথ তদন্ত করতে অস্বীকার করেছে। ‘উপরের আদেশ’ উল্লেখ করে অভিযোগ তদন্তে তারা তাদের নিষ্ক্রিয় থাকার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরত।
গত রবিবার রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে অন্তর্বর্তী রিপোর্ট তুলে দেয় কমিশনের সদস্যরা। ওই রিপোর্টের অংশ বিশেষ গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং প্রকাশ করে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারকে ভিত্তি ধরে গুমকাণ্ডে জড়িত হিসেবে র্যাব ছাড়াও ঢাকার সিটিটিসি এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে কমিশনের আংশিক রিপোর্টে। এতে বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের মানসিক, সামাজিক এবং আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরে- তা পুনরুদ্ধারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে এ ধরনের মানবতাবিরোধী ঘটনা না ঘটে- সে লক্ষ্যে ‘প্রক্রিয়াগত সংস্কার’ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাপকভিত্তিক জরুরি সহায়তার সুপারিশ করা হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিধ্বংসী ছিল। বহু লোক তাদের জীবিকা হারিয়েছে। নিখোঁজ হওয়া এবং বন্দিত্বের পরে সমাজে পুনঃএকত্রিত হওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আইনি ব্যবস্থার ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
কমিশনের রিপোর্টে আরও বলা হয়, যেসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা পুনরায় ফিরে আসত- বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর অধীনে ‘বানোয়াট অভিযোগ’-এর ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করে আদালতে নেওয়া হতো। এর ফলে গুমের শিকার ব্যক্তিরা পুনরায় অবিচারের শিকার হয়। বলপূর্বক গুমের পর ‘নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি’-কে ‘ভিত্তিহীন দাবি’ করে প্রত্যাখ্যান করত আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ; অনেক ক্ষেত্রে বলা হতো ঋণ পরিশোধের চাপ বা অন্যান্য ব্যক্তিগত বিষয় এড়াতে নিখোঁজ ব্যক্তিরা আত্মগোপনে চলে গেছে। এতে বলা হয়, যারা জীবিত ফিরে এসেছেন, তাদের পরবর্তী জীবন ছিল এক ‘অগ্নিপরীক্ষা’। ভুক্তভোগীরা অব্যাহত হুমকির মুখে, তাদের গুম হওয়ার করুণ পরিণতি তুলে ধরা বা জবাবদিহি নিশ্চিত করার চেয়ে নীরব হয়ে যাওয়াকে নিরাপদ মনে করত। উপরন্তু যারা জীবিত ফিরে আসত- তাদের অপরাধী সাজিয়ে ফৌজদারি মামলায় ফেলা হতো। এই অভিযোগগুলো কেবল তাদের খ্যাতিই কলঙ্কিত করেনি বরং তাদের জীবন পুনর্গঠনের ক্ষমতাকেও বাধাগ্রস্ত করেছে।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়ারও সমালোচনা করা হয়েছে কমিশনের রিপোর্টে। বলা হয়েছে, বিচারব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কোনো অর্থপূর্ণ প্রতিকার দিতে সমর্থ হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে দাখিল করা ‘হেবিয়াস কর্পাস’ পিটিশনগুলো প্রাথমিক ফাইলিংয়ের বাইরে খুব কমই অগ্রগতি হয়েছে, যার ফলে ভুক্তভোগীরা কোনো অর্থপূর্ণ আইনি আশ্রয় পায়নি। বলপূর্বক গুমের মামলা নিয়ে কয়েকটি আদালত রায়, ন্যায়বিচার প্রদানের চেয়ে স্থিতাবস্থাকে বৈধতা দিতে বেশি কাজ করেছে উল্লেখ করে কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, নিম্ন আদালতগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল; যে সংস্থাগুলোর অনেককে বলপূর্বক গুমের অপরাধে জড়িত পাওয়া গেছে। যথাযথ প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতি, বিচারিক সুরক্ষার অভাব এবং অপরাধীদের পদ্ধতিগত দায়মুক্তির কারণে ভুক্তভোগীদের ভয় আরও তীব্র হয়েছিল।
কমিশনের রিপোর্টে পুরুষের পাশাপাশি গুমের শিকার নারী ও শিশুদের বিষয়টিও উঠে এসেছে। কমিশন জানিয়েছে, তারা নারীর তুলনায় পুরুষ ভুক্তভোগী বেশি চিহ্নিত করছে। এর কারণ, বেশি সংখ্যক পুরুষকে জোরপূর্বক গুম করার ঘটনা ঘটেছে। আবার সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে অনেক মহিলা ভিকটিম এগিয়ে আসতে দ্বিধাবোধ করেন। তারপরও, বেশ কয়েকজন সাহসী নারী কমিশনের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। তাদের অপহরণ, আটকের সময় নির্যাতন এবং আইনি ব্যবস্থায় শেষপর্যন্ত মুক্তি দেওয়ার বিবরণ অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ ভিকটিমদের মতোই। অনেক ক্ষেত্রে, নারীদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে- পুরুষ আত্মীয়দের সঙ্গে তাদের মেলামেশার কারণে। শিশুদের তাদের মায়েদের সঙ্গে জোরপূর্বক নিখোঁজ করার এই ঘটনার সঙ্গে চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং ঢাকার সিটিটিসি কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই কার্যক্রম অব্যাহত ছিল।