কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নীতি নির্ধারণ কাঠামো গড়ে তুলতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক আইনি সংস্কারের প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘প্রস্তাবিত বাংলাদেশ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’-এ গভর্নরের পদমর্যাদা দেশের একজন পূর্ণ মন্ত্রীর সমান করার সুপারিশ করা হয়েছে।
একইসঙ্গে পরিচালনা পর্ষদে সরকারি প্রতিনিধিত্ব কমিয়ে স্বাধীন বিশেষজ্ঞ সদস্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব এড়াতে তিন সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি গভর্নরের পদমর্যাদা দেশের একজন পূর্ণ মন্ত্রীর সমান বা তারচেয়ে বেশি হওয়া উচিত। কারণ, পৃথিবীর সব দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন আছে।’’
তিনি উল্লেখ করেন “দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে এ সংক্রান্ত খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এর লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ ব্যাংককে আন্তর্জাতিক মানের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা।” তিনি বলেন, ‘‘ব্যাংক খাতকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে এই সরকারের আমলেই বাংলাদেশ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ কার্যকর হওয়া জরুরি। তা না হলে ব্যাংক খাতে যে সংস্কারই আনা হোক না কেন, তা আবার নষ্ট হয়ে যাবে।’’
গভর্নরের মর্যাদা হবে পূর্ণ মন্ত্রীর সমান
খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘‘গভর্নরের পদমর্যাদা পূর্ণ মন্ত্রীর সমান করা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং নীতিগত স্বাধীনতা আরও সুসংহত হবে। এতে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্ব, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং নীতি-সমন্বয় কার্যক্রমে ব্যাংকের অবস্থান শক্তিশালী হবে।’’
আহসান মনসুরের ভাষায়, “ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা মন্ত্রীর সমান মর্যাদা ভোগ করেন। এটি নীতি নির্ধারণে স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সহায়ক।”
পর্ষদে সরকারি প্রতিনিধিত্ব কমানো হচ্ছে
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডে রয়েছেন গভর্নর, তিন সচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান, একজন ডেপুটি গভর্নর ও চারজন বেসরকারি প্রতিনিধি। নতুন খসড়ায় সরকারি প্রতিনিধি সংখ্যা তিন থেকে কমিয়ে একজন এবং স্বাধীন বিশেষজ্ঞ সদস্য সংখ্যা চার থেকে ছয় করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
গভর্নরের মতে, “যুক্তরাজ্য, জাপান ও কানাডার মতো দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ডে সরকারি প্রতিনিধি নেই বললেই চলে। নীতিনির্ধারণে নিরপেক্ষতা ও পেশাদারত্ব নিশ্চিত করতেই বাংলাদেশেও এই কাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছে।”
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিয়োগ কাঠামো
খসড়া অনুযায়ী, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগে তিন সদস্যবিশিষ্ট সার্চ কমিটি থাকবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন সাবেক অর্থমন্ত্রী, অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা বা বিদায়ী গভর্নর।
অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটির মাধ্যমে— যাতে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের একক সিদ্ধান্তে অপসারণ সম্ভব না হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই জনবল কাঠামো, বেতন স্কেল ও পদ সৃষ্টি নির্ধারণ করতে পারবে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে নিজস্ব বিধি প্রণয়নের ক্ষমতাও পাবে প্রতিষ্ঠানটি। একইসঙ্গে পরিশোধিত মূলধন ৩ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া ব্যাংকটি সরাসরি সংসদের কাছে জবাবদিহি করবে। সংসদীয় কমিটি ব্যাংকের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা ও শুনানি পরিচালনা করতে পারবে—এমন ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
সমর্থন ও শঙ্কা
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর স্বায়ত্তশাসনের পথে একটি বড় পদক্ষেপ। তবে শেষ পর্যন্ত ফল নির্ভর করবে গভর্নরের স্বাধীন মানসিকতা ও নীতি বাস্তবায়নের দৃঢ়তার ওপর।”
অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী সতর্ক করে বলেন, “কেবল মর্যাদা বৃদ্ধি নয়, কার্যকারিতাই মূল বিষয়। অতিরিক্ত স্বাধীনতা যেন স্বেচ্ছাচারিতায় না গড়ায়—সেই নিশ্চয়তাও জরুরি।”
‘এখনই উপযুক্ত সময়’
অর্থ উপদেষ্টাকে পাঠানো এক চিঠিতে গভর্নর আহসান মনসুর লিখেছেন, ‘‘অতীতে সংস্কারের উদ্যোগ ‘রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাবে’ ব্যর্থ হয়েছে। এখনই ‘সবচেয়ে উপযুক্ত সময়’—কারণ অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামোগত সংস্কারে অঙ্গীকারবদ্ধ।’’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই সংস্কার কার্যকর হলে আর্থিক খাতে অতীতের অনিয়ম ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন’ প্রতিষ্ঠিত হবে।