Image description
► নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়ে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে পাঠদান ► মানা হয় না বিল্ডিং কোড ► জরুরি ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না ► মাইলস্টোন দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের কাছে প্রশিক্ষণের আবেদন বাড়লেও সংখ্যায় কম

একটি শিশুর জন্য বাড়ির পরই সবচেয়ে নিরাপদ স্থান স্কুল। কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবহেলা, অনাগ্রহ ও জবাবদিহির অভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল অনিরাপদ হয়ে উঠছে। দেশের অনেক স্কুল-কলেজ পুরোনো ও জীর্ণশীর্ণ। স্কুলগুলোর অনেকটি আবাসিক ভবন ভাড়া করে এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ওপর গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্লাস করছে। সেখানে নেই খেলার মাঠ, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ও বহির্গমন পথ। ফলে অগ্নিদুর্ঘটনা বা ভূমিকম্পে ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে। আবার দীর্ঘ সময় সংস্কারের অভাবে যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় দুর্ঘটনা। নতুন যেগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলো বিল্ডিং কোড মেনে হচ্ছে না। সেখানে অগ্নিনির্বাপণের জন্য নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। যে কোনো প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য দেওয়া হয় না জরুরি ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ।

রাজধানীর মিরপুরে সেনপাড়া পর্বতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি জরাজীর্ণ। এখানে শিশু থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস হয়। শিক্ষার্থী ৭৪৪ আর শিক্ষক ও স্টাফ ২৪ জন। স্কুলের প্রবেশমুখের পাশের বাউন্ডারি পুরোটাই ময়লার স্তূপে ঢাকা। অভিভাবকদের ওয়েটিং রুমটি শ্যাওলায় ঢাকা, গ্রিলগুলো মরিচা পড়া, সেখানেও অপ্রয়োজনীয় জিনিস জড়ো করা। শিক্ষকদের রুমের সিলিং থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে। স্কুল ভবনের রং উঠে, জায়গায় জায়গায় ভেঙে গেছে, জানালার কাচও ভাঙা। এ স্কুলের ভিতরেই বিকালে নিম্নবিত্তদের সন্তানদের সুবিধার জন্য শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালিত হয়। বিকালের শিফটের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আক্তার বলে, ‘স্কুলের সামনে ময়লার জন্য স্কুলে আসতে খুব খারাপ লাগে। আর জরাজীর্ণ স্কুলে ক্লাস করতেও মাঝেমধ্যে ভয় করে।’ সেনপাড়া পর্বতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিনাত মহল বেলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো              দৃষ্টিনন্দন প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা হচ্ছে। আমাদের বিদ্যালয়ও এর আওতায় আছে। আশা করছি কয়েক মাসের মধ্যেই এটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। তবে কাজ কবে নাগাদ শুরু হবে এখনো বলতে পারছি না।’

মিরপুরের ঝুঁকিপূর্ণ আরও বেশ কিছু বিদ্যালয়ের মধ্যে আছে শহীদ আবু তালেব উচ্চবিদ্যালয়। এর নিচতলা ব্যাংকের বুথ, বেকারি ও খাবারের দোকানের ব্যবহারের জন্য ভাড়া দেওয়া। আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়। এর সামনের নিচের অংশ পুরোটাই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ওপর ঝুঁকিপূর্ণভাবে স্কুল পরিচালনা করায় যে কোনো সময় অগ্নিকা  ঘটলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা আছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যে, দেশে যে পরিমাণ স্কুল-কলেজ আছে সে অনুপাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্ঘটনা মোকাবিলায় প্রশিক্ষণ নেওয়ার হার খুবই কম। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় সৃষ্ট অগ্নিকাে র পর ফায়ার সার্ভিসের কাছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অগ্নিদুর্ঘটনায় ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রশিক্ষণের আবেদন অনেক আসে। অথচ এ দুর্ঘটনার আগে এ ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য খুব কমই অনুরোধ আসত। রাজধানী ঢাকা থেকে দুর্ঘটনা রোধে যে পরিমাণ প্রশিক্ষণ গ্রহণের আবেদন এসেছে, ঢাকার বাইরে থেকে তা একেবারেই আসে না। দেশের বড় ও স্বনামধন্য কিছু স্কুল-কলেজ ছাড়া বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি করে না। এ ভবনগুলো যেভাবে তৈরির কথা সেভাবে তৈরি করা হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুপাতে যে কটি বহির্গমন পথ থাকার কথা বাস্তবে তা মানা হয় না। বেশির ভাগ স্কুল-কলেজেই অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে যেসব যন্ত্রপাতি থাকার কথা তা নেই। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় দুটি ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ার একটি স্কুলে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে জুলাইয়ে রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় স্কুল কর্তৃপক্ষের মতে ৩২ জনের মৃত্যু হয়। এর ২৬ জনই শিক্ষার্থী। বাকিদের মধ্যে আছেন স্কুলটির শিক্ষিকা, অভিভাবক ও স্টাফ। একই মাসে রাজধানীর মিরপুরে কসমো স্কুলের জেনারেটর রুম থেকে অগ্নিকা  ঘটে। তবে কেউ হতাহত হয়নি। আগস্টে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চবিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে অগ্নিকাে  ১৫ শিক্ষার্থী আহত হয়। এ ছাড়া রাজধানীর কদমতলী মুরাদপুরে স্কুলের বাউন্ডারি ভেঙে মোস্তাফিজুর রহমান নামে এক শিক্ষক মারা যান।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল এম এ আজাদ আনোয়ার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগামী বছর প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে অগ্নিদুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের করণীয় সম্পর্কে অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। শিশুদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এটি করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্কুল-কলেজ থেকে বিভিন্ন সময় ফায়ার সার্ভিসের কাছে অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে সুরক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য আবেদন করা হয়। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্কুল-কলেজে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের এলাকাভিত্তিক ইন্সপেক্টররা তদারকির ভিত্তিতে স্কুল-কলেজ কমিটিকে গাইডলাইন দিয়ে থাকেন। অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে যেসব যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে, স্কুল কমিটি যাতে সেগুলোর ব্যবস্থা করেন সে বিষয়েও বলা হয়। ফায়ার সার্ভিস থেকে দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা হচ্ছে।’

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (বিদ্যালয় শাখা) মাহফুজা খাতুন বলেন, ‘আমাদের বিভাগ থেকে জরুরি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি। তবে পরিকল্পনা বিভাগ থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। একটি স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে একটি ক্লাস্টারে বা সেন্টারে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্যোগে বিচ্ছিন্নভাবে এ প্রশিক্ষণ হয়। জরুরি ব্যবস্থাপনায় আমরা কিছু বরাদ্দ দিয়ে থাকি যখন কোনো স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভারনারিবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান বলেন, ‘বিল্ডিং কোড থাকার পরও আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তা মানা হয় না। অথচ অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নির্দিষ্ট বাজেটও আছে। জবাবদিহির ঘাটতির কারণে এ অবস্থা। কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই সবাই নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন পরই সবাই ভুলে যায়। বাইরের দেশে এসব বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ হয়। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য যা থাকা দরকার তা আছে, কিন্তু প্রশিক্ষণ হয় না। বাধ্যতামূলক হওয়ায় নতুন স্কুলগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আছে, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে এক দিন প্রশিক্ষণ হয়। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।’