Image description

গুমের শিকার গর্ভবতী নারী। সঙ্গে ১৮ মাস বয়সী ও তিন বছর বয়সী দুই সন্তান। এক মাস তাদের আটকে রাখা হয় অজানা স্থানে। যেখানে গর্ভবতী হওয়া সত্ত্বেও ওই নারীকে এক পুরুষ কর্মকর্তা পিটিয়েছেন। এমনই বীভৎস ঘটনা উঠে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গুম কমিশনের রিপোর্টে। শুধু ওই নারী নয়, বিগত সরকারের সময়ে পুরুষের পাশাপাশি গুম থেকে বাদ যায়নি নারী ও শিশুরাও। আটক করে তাদের ওপর চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ভিন্নমত দমনের অন্যতম হাতিয়ার ছিল গুম। যাদের কেউ কেউ ফিরে আসলেও অনেকে এখনো নিখোঁজ। যারা ফিরে এসেছেন তাদের কয়েকজন নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বীভৎস সব ঘটনার কথা জানিয়েছে গুম কমিশনকে। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেয়া গুম কমিশনের রিপোর্টের অংশবিশেষে এ তথ্য উঠে আসে। রিপোর্টটিতে গুম কমিশন জানায়, নারীদের তুলনায় গুম হওয়া পুরুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেশি বলে আমরা শনাক্ত করেছি। এর প্রধান কারণ সাধারণত পুরুষদেরই বেশি গুমের শিকার হতে হয়েছে। তাছাড়া নারী ভুক্তভোগীদের অনেকেই সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে তাদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করেন। তবুও কিছু সাহসী নারী তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের জানিয়েছেন। তাদের অপহরণ, আটকের সময় নির্যাতন এবং পরবর্তী সময়ে আইনি ব্যবস্থার মধ্যে পড়ার গল্প পুরুষ ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অনেকাংশে মিল রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা তাদের স্বামী বা পুরুষ আত্মীয়দের কারণে টার্গেটে পড়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা যাই হোক সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনা হয়েছে। 

শুধু ওই গর্ভবতী নারী নয়, এ রকম অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। এক্ষেত্রে গুম কমিশন এক শিশুর সাক্ষাৎকারের বিষয়টি রিপোর্টে তুলে ধরে। শিশুটি জানায়, মাত্র ৬ বছর বয়সে তাকে তার মায়ের সঙ্গে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমে (সিটিটিসি) আটক রাখা হয়েছিল। আরেক ঘটনায়, এক মা ও তার ছোট কন্যাকে র?্যাব-২ এর সদর দপ্তরে এক রাত আটক রাখা হয়েছিল। পরের দিন সকালে কন্যাকে গাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে রেখে যায় তারা। এক ইমাম তাকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেন। গুম কমিশন জানায়, মেয়েটি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে আমাদের কমিশনের সঙ্গে কাজ করছে এবং আটক অবস্থায় র‌্যাব যেখানে তাদের রেখেছিল; সেই রুম শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এ মেয়েটির মা গুম হওয়ার পর আর ফিরে আসেনি। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চলা এই ধরনের ঘটনায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে শুরু করে ঢাকার সিটিটিসি কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এক ভুক্তভোগী জানান, পুলিশ থানায় আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমার স্ত্রী ও নবজাতক সন্তানকে নিয়ে আসে। যেখানে শিশুটিকে তার মায়ের দুধ খেতেও দেয়নি পুলিশ। এর মাধ্যমে আমাকে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে।

গুম কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, কমিশন গুরুত্বের সঙ্গে ঘটনাগুলোর তদন্ত করছে যে, কেন কর্মকর্তারা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন- এসব ঘটনা সহ্য করেছেন। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, নারীদের গুমের শিকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শিশুদেরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন মায়েরা বেছে নিতে বাধ্য হন যে, তারা তাদের সন্তানকে আটক অবস্থায় সঙ্গে রাখবেন না কি রাষ্ট্রীয় শিশু সেবাকেন্দ্রে পাঠাবেন। এর কারণ হচ্ছে সরকারি সেবাকেন্দ্রগুলো অবহেলা ও নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। তাই মায়েরা সাধারণত সন্তানদের নিজের সঙ্গেই রাখতে চান। এ ছাড়া তাদের আত্মীয়দের হাতেও তুলে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু গুমের কারণেই পরিবারের কাছে তাদের অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য পৌঁছায় না বলে এই সিদ্ধান্তও নেয়ার সুযোগ থাকে না। গুম কমিশন মনে করে নারী ও শিশুদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এসব দুঃসহ ঘটনা ভুক্তভোগীদের সুবিচার পাওয়া ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবিকে জোরালো করবে। 

এ ছাড়াও গুম কমিশনের রিপোর্টে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের বহুমুখী সংকটের বিষয়ও উঠে আসে। যেখানে পরিবারগুলো মানসিক নির্যাতন থেকে শুরু করে আইনি ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের বিষয়টি স্থান পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা এসব পরিবারের সদস্যদের সার্বক্ষণিক নজরদারি, হয়রানি এবং হুমকির মধ্যে রাখতেন। প্রিয়জনের খোঁজ চাইলে কেবল ভয় দেখানো ছাড়া তাদের কিছুই মিলতো না। কিছু কিছু পরিবার ভয়ের মধ্যেও তাদের সদস্যদের সন্ধানে বিভিন্ন সময় সোচ্চার হয়েছেন বলেও রিপোর্টে উঠে আসে।