দেশের ব্যবসায়িক অঙ্গন এখন সবচেয়ে দুর্বিষহ অবস্থা পার করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি-এসব বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সবাই এখন বলছেন, ব্যবসা করার খরচ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। নতুন বিনিয়োগ নেওয়ার সাহস এখন খুব কম মানুষেরই আছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েছে, শিল্পে জ্বালানি (গ্যাস-বিদ্যুৎ) সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে, উৎপাদন খরচ আকাশ ছুঁয়েছে এবং ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন বিনিয়োগ থমকে গেছে। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যাংকিং খাতে সংস্কার আনতে হবে। পাশাপাশি সুদের হার কমিয়ে তারল্য সংকট কমাতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অপরিহার্য। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসা পর্যন্ত ব্যবসায় স্থবিরতা অব্যাহত থাকতে পারে। সরকারের উচিত দ্রুত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে ব্যবসায়িক আস্থা ও পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই), ঢাকার সভাপতি কামরান তানভীরুর রহমান বলেন, ‘মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে গেছে। এখানেই স্পষ্ট, বিনিয়োগ কমে গেছে। যেভাবে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, সেভাবে পণ্যের দাম পাওয়া যাচ্ছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের চাহিদাও কমে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন হওয়ার পর রাজনৈতিক বোঝাপড়া হলে এ পরিস্থিতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব বলে আমরা মনে করি। বিনিয়োগকারীরা নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। সবাই অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। নির্বাচন হলেই এ অনিশ্চয়তা কিছুটা কেটে যাবে।’
গত অর্থবছরে দেশের ব্যবসায় পরিবেশে যে চাপ তৈরি হয়েছিল, নতুন অর্থবছরে তা কিছুটা শিথিল হলেও মৌলিক অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামান্য অগ্রগতি হয়েছে কিছু খাতে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে পরিবেশ এখনো অনিশ্চয়তায় ঘেরা। তাদের মতে, ব্যবসায়িক পরিবেশে এখনো কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। ব্যবসা চালানো এখন আগের চেয়ে ব্যয়বহুল ও জটিল হয়ে পড়েছে। নতুন ব্যবসা শুরু করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সাম্প্রতিক বিবিএক্সের এক জরিপে ৭৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি ও আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক, ওষুধ ও পাইকারি বাণিজ্যে। ৫৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে এবং ৬০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় সমস্যায় পড়েছে।
শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, উচ্চ সুদের হারই এখন সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। ব্যাংক ঋণ দুই অঙ্কে চলে যাওয়ায় পুঁজির খরচ বেড়েছে দ্বিগুণের মতো। জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম বাড়ায় উৎপাদন ব্যয়ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক কারখানা এখন ডিজেল জেনারেটরে চলছে, যা প্রতি ইউনিটে উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। একাধিক শিল্প এলাকায় উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, শুধু জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায়। পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভে সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন ঘটছে। একাধিক শিল্পপতি বলছেন, এখন বিনিয়োগের আগে সবাই অপেক্ষা করছে, পরিস্থিতি কতটা স্থিতিশীল হয় সেটা দেখার জন্য। তবে সামগ্রিকভাবে, ব্যবসার ব্যয়ই এখন সবচেয়ে বড় আলোচ্য।