Image description
দমন-পীড়ন ও খুন-গুমে অভিযুক্ত পুলিশ

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের ১৬ বছর খুন, গুম, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরসহ নানা অপরাধে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের সুকৌশলে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। অন্তর্ববর্তীকালিন সরকারে ঘাপটি মেরে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর, এসবি এবং একটি গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত প্রভাবশালী কর্মকর্তারা নানা অপরাধে অভিযুক্ত এ সব পুলিশ কর্মকর্তাদের পালাতে সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এরই মধ্যে গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে সংঘটিত বেশিরভাগ গুমের পেছনে পুলিশ, র‌্যাব, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) কর্মকর্তারা জড়িত ছিল। গুমের শিকার ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করেন। সে সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের ব্যাপক দমন-পীড়নের অভিযোগ উঠে। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়।

সর্বশেষ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদা থেকে পালিয়েছেন সাপ্লাই বিভাগের দায়িত্বে থাকা ডিআইজি এহসানুল্লাহ। বুধবার ২৯ অক্টোবর ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত থাকায় তাকে গ্রেফতারে পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালায় একটি দল। এ সময় তিনি মটরসাইকেল যোগে পালিয়ে যান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত সময়ের প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনৈতিকভাবে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের প্রতি মানুষের ক্ষোভ আছে, কারণ পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন না করে আওয়ামী সরকারের ক্যাডার হিসেবে কাজ করেছে। কমান্ডিং থেকে নিচের স্তর পর্যন্ত সবাই অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে সময় পার করেছে। আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবাহ হয়ে কাজ করতে হয়েছে পুলিশকে। অন্যায় আদেশ পালন করার পাশাপািশ সবকিছুতে পুলিশ টাকা নিয়েছে বলে একটা দুর্নাম ছিলো। এ অবস্থা থেকে পুলিশকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখন আর কোনো রাজনৈতিক দলের চাপ নেই। পুলিশে অনেক আবর্জনা আছে। এগুলো দূর করতে হবে। পেশাদার, সৎ, যোগ্য ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়ার মাধ্যমে পুলিশের হারানো সুনাম ফিরিয়ে আনতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে শীর্ষ পর্যায়ের যেসব পুলিশ কর্মকর্তা যে দমন-পীড়ন ও খুন গুমে যারা জড়িত ছিলেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সাবেক আইজিসহ তাদের ৯৫২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ক্ষতিগ্রস্ত স্বজনরা। তবে এখন পর্যন্ত শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাসহ ৩২ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হলেও পলাতক রয়েছে ৯২৪ জন। ৩২ পুলিশ সদস্যের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। আর পলাতকদের মধ্যে শীর্ষ কর্মকর্তার তালিকায় রয়েছেন, সাবেক ডিবি প্রধান ও সাবেক ডিআইজি মোহাম্মদ হারুন-অর রশীদ, আওয়ামী লীগ সরকারে অত্যান্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি অতিরিক্ত আইজি মনিরুল ও হাবিবুর রহমান, অতিরিক্ত ডিআইজি টুটুল চক্রবর্তী, মারুফ হোসেন সরদার, বিপ্লব কুমার সরকার, খন্দকার নুরুন্নবী, এস এম মেহেদী হাসান, উত্তম কুমার পাল, লিটন কুমার সাহা, সঞ্জিত কুমার রায়, মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, মো: আলমগীর হোসেন, নাবিদ কামাল শৈবাল, সুদ্বীপ কুমার চক্রবর্তী ও প্রলয় কুমার জোয়াদ্দারসহ অনেকেই।

পুলিশ বাহিনীতে পেশাদার কর্মকর্তাদের অভিমত, যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা, তারাই এখন পুরস্কৃত হচ্ছেন। সরকারের এমন পদক্ষেপে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ কারনে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যেও এক ধরনের হতাশা রয়েছে। বিদায়ী সরকারের ক্ষমতায় থাকার সময় নির্বাচনসহ নানা বিতর্কিত কর্মকা-ে যুক্ত কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। এতে প্রশাসনে যোগ্যতার পরিবর্তে আনুগত্যই প্রাধান্য পাচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। জুলাই বিপ্লবের পরও এরা বহাল থাকায় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ সদর দফতর, এসবি, ডিএমপি ও সিআইডিসহ ঢাকাস্থ বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত জাতীয়তাবাদ ও ইসলামপন্থীদের গত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময় ব্যাপকভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। পুলিশে আওয়ামী সিন্ডিকেটের সহযোগীরা ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ের সুবিধা বাগিয়ে নিয়ে গোপনে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের তথ্য ফাঁস ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহন করা না হলে আগামীতে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

বিসিএস ২০তম ব্যাচের একজন পুলিশ কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী, খুন, গুম, টেন্ডার বানিজ্য, বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্যাতনসহ নানা অপরাধে সম্পৃক্ত দেড় শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এখনো বহাল তবিয়তে। দলের লেজুড়বৃত্তি করা বহুল আলোচিত সেই কর্মকর্তারা এখন নেই। রীতিমতো পুলিশের মেরুদ- ভেঙে দেয়ার মতো অবস্থা তৈরি করে তারা চলে গেছেন। আমরা মর্যাদাশীল একটি পুলিশের অবস্থান চাই। যেখানে সরকার পরিবর্তনের পরও যেন পুলিশের মেরুদ- ঠিক থাকে। কোনো পুলিশ সদস্যকে পালাতে না হয়।

বিসিএস ১৮তম ব্যাচের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ঘাপটি মেরে থাকা কিছু কর্মকর্তা গাছেরটাও খেয়েছে, এখন তলারটাও কুড়াচ্ছেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে যিনি জেলার এসপি, তিনি এখন রেঞ্জ ডিআইজি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ার পেছনে মূল কারিগর তারাই। এক সময় পুলিশ সদর দফতরসহ পুলিশের সকল ইউনিটের টেন্ডার বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ যার হাতে ছিল সেই কর্মকর্তারা এখন পুলিশ সদর দফতর, এসবি ও সিআইডিতে প্রভাবশালী। অন্তবর্তীকালিন সরকারে থেকে এরা পতিত আওয়ামী লীগের পলাতক ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য পাচার করছে বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন। পতিত আওয়ামী সরকারের সময় আইনের পোশাক পরে যারা অন্যায়ভাবে খুন, গুমর ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দমন-পীরন করেছেন তদন্ত করে দ্রুত এসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা না হলে জনতার পুলিশ করা সম্ভব নয়।