Image description

প্রশাসনে বেশ কয়েকজন অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই পদোন্নতির মাধ্যমেই বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৭তম ব্যাচের পদোন্নতি শুরু হচ্ছে। পদোন্নতির জন্য ইতোমধ্যে যোগ্য কর্মকর্তাদের বাছাই করেছে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)। বাছাইয়ের পর সুপারিশপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া বাকি সবাই আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। যারা গত ১৬ বছর নিজেদের আওয়ামীপন্থী হিসেবে জাহির করে শেখ হাসিনার অনুগত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে কাজ করেছেন। এসব কর্মকর্তা এখন ভোল পাল্টিয়ে আগামী নির্বাচনে সরকার গঠন করতে পারে এমন রাজনৈতিক দলের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে প্রশাসনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সচিব পদ শূন্য রয়েছে। যোগ্য কর্মকর্তা না থাকায় এসব পদে পদায়ন করতে পারছে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই শূন্যতা কাটাতে সচিব পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই পদোন্নতির জন্য বিসিএস ১৭তম ব্যাচকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। এই ব্যাচের প্রায় দেড় ডজন কর্মকর্তাকে সচিব পদোন্নতির জন্য বাছাই করেছেন এসএসবির সদস্যরা। এই বাছাইয়ে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দিয়ে পদোন্নতিবঞ্চিত রাখা কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার না দিয়ে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা ১৯৯৮ সালের আওয়ামী শাসনামলে যোগদান করেন। এই ব্যাচের পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ন্ত্রণ করতেন ৫ আগস্টের পরে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের স্ত্রী শায়লা ফারজানা। তার মৌখিক নির্দেশনা ছাড়া এই ব্যাচের কোনো কর্মকর্তার পদোন্নতি এবং পদায়ন সম্ভব ছিল না। বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দিয়ে পদোন্নতি ও পদায়নবঞ্চিত হওয়া তার কয়েকজন ব্যাচমেট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর পদোন্নতি পান। ৭ আগস্ট এই কর্মকর্তাকে মন্ত্রণালয় থেকে তাড়িয়ে দেন দীর্ঘদিন বঞ্চিত ও তার হাতে হয়রানির শিকার কর্মকর্তারা। এরপর তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

৫ আগস্টের পর লাঞ্ছিত হওয়া কর্মকর্তাকে সচিব পদোন্নতির সুপারিশ : ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব শায়লা ফারজানাকে তাড়িয়ে দেন বঞ্চিত কর্মকর্তারা। এরপর একই মন্ত্রণালয়ের শায়লার ঘনিষ্ঠ ও আওয়ামী সুবিধাভোগী অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ জিয়াউল হককে ধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দেন বঞ্চিত কর্মকর্তারা। এ সময় তিনি নিজের ব্যবহৃত ল্যাপটপ নিতে চাইলে সেটিও নিতে দেননি। পরে তার কর্মচারীরা তাকে ল্যাপটপটি পৌঁছে দেন। এরপর এই কর্মকর্তাকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে বদলি করা হয়। সেখানে যোগদানের পর মন্ত্রণালয়ের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র সচিব মো: এহছানুল হকের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন এই কর্মকর্তা। এরপর মো: এহছানুল হক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি হলে জিয়াউল হককে এপিডি উইংয়ে পদায়নের আগ্রহ দেখান। এটি হলে জনপ্রশাসন সচিবকে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে এটি ভেবে তাকে এপিডিতে পদায়ন করা হয়নি। এরপর এই কর্মকর্তাকে শিগগিরই সচিব পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে বলে জনপ্রশাসন সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জিয়াউল হকের ব্যক্তিগত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই কর্মকর্তা শায়লা ফারজানার ঘনিষ্ঠ আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা হওয়ায় ২০১৫ থেকে শেখ হাসিনার পতন পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন। এর আগে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, ১/১১ সরকারের সময় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে কাজ করেছেন।

একই সাথে সচিব পদোন্নতির জন্য তদবির চালাচ্ছেন তার স্ত্রী ও একই ব্যাচের কর্মকর্তা ড. নুরুন্নাহার চৌধুরী। শায়লা ফারজানার মায়াবতি গ্রুপের এই সদস্য কৃষি মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করেছেন।

পদোন্নতির জন্য জোর তদবির চালাচ্ছেন আর্থিক খাত ধ্বংস ও অর্থনীতির ডাটা ম্যানিপুলেশনের প্রধান হোতা সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদারের ঘনিষ্ঠ থেকে দীর্ঘদিন অর্থ বিভাগে কর্মরত বিলকিস জাহান রিমি। এই কর্মকর্তা ২০১২ সালে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে বর্তমান অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ বছর অর্থ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন। মাঝখানে দুই বছর তিনি একটি প্রকল্পে দুই বছর লিয়েনে ছিলেন।

পদোন্নতির দৌড়ে এগিয়ে আছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন পদায়নে থাকা অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মোস্তফা জামান। জননিরাপত্তা বিভাগে থাকাকালে এ বিভাগের প্রশাসন, অর্থ ও মেডিক্যাল অনুবিভাগ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অধিশাখা ও আইসিটি সেলের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১৬ সালের উপসচিব হিসেবে এ মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। এরপর একাধিক পদোন্নতি পেলেও তাকে স্বরাষ্ট্র থেকে বদলি করা হয়নি। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনে বদলি করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়াও এই কর্মকর্তা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমিতে কাজ করেছেন।

পদোন্নতির জন্য জোর তদবির চালাচ্ছেন প্রশাসনে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের পুনর্বাসনের অভিযোগে সরিয়ে দেয়া অতিরিক্ত সচিব (এপিডি) মো: আব্দুর রউফ। যিনি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। এই কর্মকর্তা ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী কমিশনার পদে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় খুলনায় যোগদান করেন। সহকারী কমিশনার হিসেবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বাগেরহাট ও ঝিনাইদহে চাকরি করেন। এরপর ২০০৩ সালের ৩ জুন সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। ওয়ান-ইলেভেনের পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর ২০১৫ সালের ২৯ মার্চ তাকে পদায়ন হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে। যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি পান ২০১৯ সালের ১৬ জুন। এ সময় তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এবং নীতিনির্ধারণী মন্ত্রণালয় নামে বিবেচিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। গত বছরের ২২ মার্চ তাকে অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর তাকে ভূমি মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।

সচিব হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন পালিয়ে যাওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের সাথে কাজ করা পরিবহন কমিশনার মো: খায়রুল কবীর মেনন। গণ-অভ্যুত্থানের পরে এই কর্মকর্তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে ভূমি সংস্কার বোর্ডের সদস্য হিসেবে পদায়ন করা হয়। এর আগে এই কর্মকর্তা আরেক দফায় ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন। আওয়ামী আস্থাভাজন হওয়ায় নিয়মিত পদোন্নতি পেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন।

সচিব পদোন্নতির দৌড়ে আছেন আওয়ামী রেজিমের লাখো কোটি টাকা পাচারের সুযোগদাতা সাবেক সচিব রউফ তালুকদারের আস্থাভাজন অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো: হাসানুল মতিন। এই কর্মকর্তা ১/১১ এর সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। এ ছাড়াও গত ১৫ বছর আওয়ামী আস্থাভাজন হয়ে নিয়মিত পদোন্নতি পেয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, পদ্মা সেতু প্রকল্পের উপপরিচালক, ২০১৬ থেকে বর্তমান পর্যন্ত অর্থ বিভাগে কাজ করেছেন। এর মধ্যে এক বছর লিয়েনে ছিলেন।