Image description

দেশে বিক্রি হওয়া সাজসজ্জার কাজে ব্যবহৃত রঙে বিপজ্জনক মাত্রায় ভারী ধাতু সিসা শনাক্ত হয়েছে। কিছু রঙে সিসার পরিমাণ বাংলাদেশে নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমা ৯০ পিপিএম ছাড়িয়ে ১ লাখ ৯০ হাজার পিপিএম পর্যন্ত পৌঁছেছে। এসব রং মূলত ক্ষুদ্র, অনিবন্ধিত বা লেবেলহীন উৎপাদকদের তৈরি। তারা বাজারের প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ দখল করে আছে। 

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় এসডোর প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘রঙে সিসার উপস্থিতি ও সিসামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অগ্রগতি মূল্যায়ন’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে লেড এক্সপোজার এলিমিনেশন প্রজেক্ট এবং ইন্সটিগ্লিওর সহযোগিতায়।

গবেষণায় ১৬১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৯৩টি (৫৭ দশমিক ৮ শতাংশ) নমুনায় সিসার পরিমাণ নিরাপদ মাত্রা ৯০ পিপিএমের নিচে ছিল। বাকি ৬৮টি নমুনা (৪২ দশমিক ২ শতাংশ) বিএসটিআই নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ নমুনায় সিসার পরিমাণ ১ হাজার পিপিএমের বেশি এবং ৩ দশমিক ১ শতাংশে ৫০ হাজার পিপিএম ছাড়িয়েছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক নমুনাটি ছিল ক্যাঙ্গারু ব্র্যান্ডের একটি রং, যাতে ১ লাখ ৯০ হাজার পিপিএম পর্যন্ত সিসা পাওয়া গেছে। এরপর রয়েছে ইউরো ব্র্যান্ড (১ লাখ ৭০ হাজার পিপিএম), নাহার (৮১ হাজার), নিউ টুয়া (৭৪ হাজার), টপ সিল (৫৪ হাজার), মদিনা বেটার রুবিল্যাক (১৯ হাজার), মেঘনা প্লাস (১৮ হাজার), র‍্যামি (১৮ হাজার) ও তুর্কি (১৬ হাজার)। এসব রঙের বেশির ভাগই ছিল হলুদ বা সোনালি-হলুদ রঙের অয়েলভিত্তিক ডেকোরেটিভ রং– যে রঙেই গবেষণায় সবচেয়ে বেশি সিসার উপস্থিতি ধরা পড়ে। লাল ও সাদা রঙেও সিসার মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেশি ছিল।

গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ২১ দশমিক ৬ শতাংশ রঙে (৩৫টি নমুনা) সিসামুক্ত বা পরিবেশবান্ধব লেখা লেবেল ছিল। জরিপে অংশ নেওয়া দোকানদারদের অর্ধেকের বেশি বিএসটিআই নির্ধারিত ৯০ পিপিএম সীমা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, ১০ হাজার পিপিএমের বেশি সিসাযুক্ত সব নমুনাই এসেছে ছোট বা অনানুষ্ঠানিক উৎপাদকদের কাছ থেকে। পাশাপাশি চীন, সিঙ্গাপুর ও কিছু অঘোষিত আমদানি করা রঙেও অসংগতিপূর্ণ সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং কাস্টমস স্ক্রিনিংয়ে দুর্বলতা নির্দেশ করে।

সংবাদ সম্মেলনে এসডোর চেয়ারম্যান ও সরকারের সাবেক সচিব সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এখনই সব রং থেকে সিসা নির্মূল করা জরুরি। উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার– সব ক্ষেত্রেই দায়িত্ব ভাগাভাগি করতে হবে। 

সংস্থার সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, এই গবেষণা মনে করিয়ে দেয়, শুধু আইন করলেই হবে না, বাস্তবায়নই মূল চাবিকাঠি। এটি কাউকে দোষারোপের বিষয় নয়, বরং একটি সম্মিলিত জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলার আহ্বান।

এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, আমরা যে রং ব্যবহার করি, তা যদি নিরাপদ না হয়, তবে সেটি প্রতিটি পরিবার, শিল্পী ও কর্মীর মানসিক উদ্বেগ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সিসামুক্ত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শিল্প খাত ও সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন বলেন, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সম্পূর্ণ সিসা নির্মূল করা। বাজার থেকে লেড ক্রোমেট পাউডার বিলুপ্ত করার কৌশল এখনই নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হাশেম বলেন, সিসা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত করে। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বুদ্ধিমত্তা ও স্বাস্থ্য উভয়কেই হুমকির মুখে ফেলে। তাই ৯০ পিপিএম সীমা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

বিএসটিআইর পরিচালক (কেমিক্যাল উইং) খোদেজা খাতুন বলেন, যেসব ব্র্যান্ড মানদণ্ড মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কিছু প্রক্রিয়াগত জটিলতা রয়েছে। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। বিএসটিআইর সহকারী পরিচালক (কেমিক্যাল স্ট্যান্ডার্ডস উইং) মো. মঞ্জুরুল করিম বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়ম এড়িয়ে চলে। তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে নতুন উপায় বের করতে হবে। পাশাপাশি শিল্প রঙের ক্ষেত্রেও নীতিমালা জরুরি।

গবেষণার ভিত্তিতে এসডো বাধ্যতামূলক সেফটি লেবেল, নিয়মিত বাজার নজরদারি, স্বাস্থ্যঝুঁকি মূল্যায়ন এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় জোরদার করার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি নিরাপদ প্যাকেজিং, টেকসই উৎপাদন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিকেও গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।