Image description

ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু

স্ট্রোক একটি ঘাতক ব্যাধি। প্রতিবছর প্রায় দেড় কোটি মানুষ এ রোগের আক্রান্ত হন। এর মধ্যে মারা যান অর্ধকোটি মানুষ, আর অর্ধকোটি পঙুত্ব বরণ করেন। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ এটি। মারা যাওয়াদের দুই-তৃতীয়াংশ আমাদের মত দেশে ঘটে। দিন দিন স্ট্রোক আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এ হার প্রায় ৮০ গুন বেড়ে যাবে। বাংলাদেশেও এ হার কিন্তু কম নয়। গবেষণা বলছে, দেশে প্রতি এক হাজার জনে প্রায় ১২ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। ঘাতক এ ব্যাধি থেকে বেঁচে থাকতে সচেতনতার বিকল্প নেই।

 

স্ট্রোক কি?

বিজ্ঞাপন

স্ট্রোক মস্তিষ্কের একটি অসুখ। মস্তিষ্কের রক্তনালীর রোগ এটি। স্ট্রোক দু-ধরনের।

১. ইসকেমিক স্ট্রোক

২. হেমোরেজিক স্ট্রোক

ইসকেমিক স্ট্রোক- মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাধলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যায়। ফলে মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট হয়ে যায়। শুরুতে কোষগুলো রক্ত চলাচল কমে গেলেও বেঁচে থাকতে পারে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর কোষগুলো মারা যায়। একে বলে কোর। কোরের চার পাশে মস্তিষ্কের বেশ কিছু অংশেও রক্ত কমে যায়। একে বলে প্যানামব্রা। যদি প্যানামব্রা অংশে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা যায় তাহলে স্ট্রোকের ভয়াবহতা অনেকটা কমানো যায়।

হেমোরেজিক স্ট্রোক - মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিড়ে গেলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়।

কারণ কি?

সম্প্রতি ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের ৩২টি দেশের মানুষ্কে নিয়ে এ গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে বলা হয়েছে, মাত্র ১০টি কারণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ৯০ ভাগ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়। তাদের মতে এ দশটি হলো-

১. উচ্চ রক্তচাপ

২. ডায়াবেটিস

৩. রক্তে কোলস্টেরলের আধিক্য

৪. স্থুলতা

৫. ধুমপান

৬. মদপান

৭. হার্টের রোগ

৮. শারীরিক পরিশ্রম না করা

৯. মানসিক আবসাদ

১০. সঠিক খাদ্যাভ্যাস না মানা

এ কারণগুলো কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আরও কিছু কারণ আছে যেগুলোর জন্যও স্ট্রোক হতে পারে। যেমন বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝুঁকি বাড়ে, পুরুষদের ঝুঁকি বেশি, বংশে কাছের আত্মীয়দের স্ট্রোকের ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বাড়ে। রক্তনালীর সমস্যা যেমন রক্তনালীতে ফোস্কা বা এনিউরিজম বা এভিএম বা রক্তনালী অস্বাভাবিক কমিউনিকেশনের জন্যও স্ট্রোক হতে পারে।

স্ট্রোকের লক্ষণগুলো:

স্ট্রোকের উপসর্গ হলো শরীরের কোন এক পাশ অবস হয়ে যাওয়া বা ঝিমঝিম করা, মুখ বেঁকে যাওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা বা একটা জিনিস দুটো দেখা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা অস্বাভাবিক আচরণ করা, ভারসাম্যহীনতা। স্ট্রোকে তীব্র মাথা ব্যথা হতে পারে। স্ট্রোকে শুরুতেই সিটিস্ক্যান। স্ট্রোকে আরোও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। স্ট্রোকের চিকিৎসায় সাড়ে চার ঘন্টার মধ্যে আসলে আইভি থ্রোম্বোলাইসিস করে রোগীকে সুস্থ করা যায়। এ সময় পার হলে ওষুধ ও রিহ্যাবিলিটেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।

স্ট্রোকের আছে চিকিৎসা:

হার্ট অ্যাটাক হলে আমরা রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেই। হৃদপিণ্ডের রক্তনালীতে রক্ত জমে গেলে হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল ব্যহত হয়। ফলে হৃদপিণ্ডের মাংসপেশি নষ্ট হয়ে যায়। একেই বলে হার্ট অ্যাটাক। হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত নিশ্চিত হওয়ার পর চিকিৎসক হার্টের রক্তনালীতে জমাটবাধা রক্ত গলিয়ে ফেলতে এক ধরনের ওষুধ শিরাপথে দিয়ে থাকেন। একে বলে স্ট্রেপ্টোটোকাইনেজ। একইরকমভাবে মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাধলে জমাট বাধা রক্ত গলিয়ে ফেলতে একধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। মস্তিষ্কের স্ট্রোকে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় তাকে বলে এল্টিপ্লেজ।

যাদের রক্তনালী রক্ত জমে বন্ধ হয়ে যায় যাকে ইস্কেমিক স্ট্রোক বলে। তাদেরকে এল্টিপ্লেজ দেয়া যায়। আবার সব ইস্কেমিক স্ট্রোক রোগীকে এ চিকিৎসা দেয়া যায় না। তো কাদের দেয়া যায়? উত্তরে আমরা বলি-

১. যাদের ইস্কেমিক স্ট্রোক হয় এবং উপসর্গ দেখা দেয়ার সাড়ে চার ঘন্টার মধ্যে যদি হাসপাতালে আসেন তাহলে দেয়া যায়।

২. অনেকের ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক হয়। তাদের তো সময় মাপা সম্ভব হয় না। তাদের ক্ষেত্রে এমআরআই পরীক্ষা করে দেখতে হয় এ চিকিৎসা দেয়া যাবে কিনা। যদি এম আর আই পরীক্ষা সন্তোষজনক হয় তাহলে এ চিকিৎসা দেয়া যায়

৩. বয়স ১৮ বছরের বেশি হতে হবে।

১৯৯৬ সালে এফডিএ স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা হিসেবে এল্টিপ্লেজের অনুমোদন দেয়। তখন থেকেই বিশ্বব্যাপী স্ট্রোকের চিকিৎসা হিসেবে আইভি থ্রোম্বলাইসিস ব্যবহার করা হচ্ছে। আধুনিক এ চিকিৎসার ফলাফল কিন্তু বেশ আশাব্যঞ্জক। গবেষণায় দেখা গেছে, এ চিকিৎসা পাওয়া রোগীদের ৭০ শতাংশের উন্নতি হয়। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের আইভি থ্রোম্বলাইসিস করা হয়েছে তিন মাস পর এদের ৫০ শতাংশ ব্যক্তি নিজের কাজ নিজেই করতে পারেন, ১৫ শতাংশ অন্যের কিছু সাহায্য দরকার হয়, ১৫ শতাংশ অন্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হন ও ২০ শতাংশ মারা যান। কাজেই প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। এ সংখ্যা কিন্তু অনেক বেশি। স্ট্রোকের চিকিৎসা নেই তা কিন্তু আর ঠিক নয়। স্ট্রোক হলেই যে অন্যের ওপর বোঝা হবেন তাও ঠিক না।

মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি- স্ট্রোক অত্যাধুনিক চিকিৎসা:

ইস্কেমিক স্ট্রোকের রোগী সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে আসলে তাদের এল্টিপ্লেজ দিয়ে আইভি থ্রম্বোলাইসিস করা যায়। কিন্তু এ সময়ের পরে আসলে কি আর চিকিৎসা নেই? না, চিকিৎসা আছে। স্ট্রোকের ৬ ঘন্টার মধ্যে আসলে অত্যাধুনিক চিকিৎসা করা সম্ভব। এ-র নাম হলো মেকানিকাল থ্রোম্বেক্টমি। রোগীকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে গিয়ে হার্টের এনজিওগ্রামের মত ব্রেনের এনজিওগ্রাম করা হয়। যদি তাতে দেখা যায় মস্তিষ্কের মোটা রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধেছে তাহলে একটি বিশেষ সাহায্যে জমাটবাধা রক্ত টেনে বের করে আনা হয়। ফলে বন্ধ রক্তনালী খুলে যায়। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়। শতকরা ৭০ ভাগ রোগী এতে সুস্থ হয়ে যান। আমাদের দেশেও এ চিকিৎসা অল্প-বিস্তর হচ্ছে।

বারবার স্ট্রোক প্রতিরোধে রক্তনালীতে স্ট্যান্টিং:

অনেকে দেখা যায় একাধিকবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তাদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের রক্তনালী সরু হয়ে থাকতে পারে। হার্টে যেমন স্ট্যান্ট বসিয়ে সরু রক্তনালী মোটা করা হয়। মস্তিষ্কের সরু রক্তনালীতেও স্ট্যান্ট বসিয়ে মোটা করার দরকার হয়। এজন্য স্ট্রোকের পর অবশ্যই রক্তনালী সরু আছে কিনা তা জানার জন্য পরীক্ষা যেমন ডুপ্লেক্স স্টাডি অব নেক ভ্যাসেল বা সিটিএ অব নেক ভ্যাসেল করতে হবে। দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে এ চিকিৎসা বেশ প্রচলিত।

স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয়:

শতকরা ৯০ ভাগ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়। স্ট্রোকের মুল কারণগুলো প্রতিরোধ করতে পারলে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়। নিচের কাজগুলো নিয়ন্ত্রণে করলে ৯০ শতাংশ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়।

১. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা

২. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা

৩. রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ রাখা

৪. ওজন নিয়ন্ত্রণ করা

৫. ধূমপান না করা

৬. মদ্যপান বর্জন করা

৭. সুষম খাদ্য অভ্যাস মেনে চলা

৮. মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকা

৯. শারীরিক পরিশ্রম করা

 

লেখক: স্ট্রোক ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ

সহকারী অধ্যাপক ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগ

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস)