Image description

উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন, বিদেশে উন্নত জীবনের স্বপ্ন- এই দুটো আকর্ষণই এখন অসংখ্য তরুণীর জীবনে পরিণত হচ্ছে দুঃস্বপ্নে। সম্প্রতি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে: তথাকথিত ‘স্পাউস ভিসা’ বা বিবাহভিত্তিক ভিসার মাধ্যমে অসংখ্য বাংলাদেশি নারীকে পাচার করা হচ্ছে চীনে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্ব, ভুয়া বিয়ের নাটক, জাল কাগজপত্র- সবমিলিয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র বছরের পর বছর ধরে এই ভয়াবহ প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর উত্তরায় এই চক্রের সক্রিয় কেন্দ্র আবিষ্কারের পর র‌্যাব চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে তদন্তে জানা গেছে, শুধু এই চারজনই নয়- একটি বড় নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের ভেতর থেকে পরিচালিত হচ্ছে, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কিছু অসাধু কর্মকর্তা, ভুয়া কাজি, এমনকি কিছু ট্রাভেল এজেন্সিও। চীনে পৌঁছে নারীদের বাধ্য করা হচ্ছে যৌন ব্যবসায়, আর কেউ অস্বীকার করলে সহ্য করতে হচ্ছে নির্মম শারীরিক নির্যাতন। এ যেন ‘স্বপ্নভঙ্গের মঞ্চে’ দাঁড়িয়ে অসহায় হয়ে পড়া নারী জীবনের এক মর্মান্তিক গল্প।
যেভাবে
ঢাকার উত্তরা, বনানী, বাড্ডা ও মিরপুর- এই চারটি এলাকার মধ্যেই গত এক বছরে অন্তত ৩০ জন নারী ‘স্পাউস ভিসা’র মাধ্যমে চীনে পাঠানো হয়েছে বলে র‌্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই এখনো নিখোঁজ, কেউবা বিভিন্ন কূটনৈতিক উপায়ে দেশে ফিরতে পেরেছেন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বয়ে নিয়ে।
গত ১৫ অক্টোবর দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক আজিজ বলেন, “চক্রটি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজ করত। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুন্দরভাবে সাজানো ভুয়া প্রোফাইল ব্যবহার করে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলত। পরে ‘বিয়ে’ ও উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ঢাকায় আনা হতো।”
তিনি আরও বলেন, “ঢাকায় এনে চক্রটি তাদের কিছু চীনা নাগরিকের সঙ্গে ভুয়া বিয়ের আয়োজন করত। এসব বিয়েতে স্থানীয় কিছু অসাধু কাজি ও এনআইডি তৈরিকারক জড়িত ছিল। এক রাতের মধ্যে তৈরি করা হতো জাল কাবিননামা ও পাসপোর্টের নথি। এরপর ‘স্পাউস ভিসা’ দেখিয়ে খুব সহজেই মেয়েদের পাঠানো হতো চীনে।”
ভুক্তভোগীর বয়ান: টিকটক থেকে চীনের দুঃস্বপ্নে
রাজধানীর কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা ২৪ বছর বয়সী তাসনিম (ছদ্মনাম) এক সময় টিকটকে সক্রিয় ছিলেন। সেই মাধ্যমেই এক চীনা নাগরিকের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। কিছুদিনের মধ্যেই তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয় চীনে গিয়ে চাকরির। তাসনিম বলেন, “তারা বলেছিল, মাসে এক লাখ টাকার মতো বেতন পাব। বিয়ের জন্য একজন বাংলাদেশি দোভাষীকে দিয়ে আমার ‘চুক্তি বিয়ে’ হয় ঢাকায়। এরপর দুই সপ্তাহের মধ্যে আমাকে চীনে পাঠানো হয়।” চীনে পৌঁছানোর পর তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়।
“বিমানবন্দর থেকে আমাকে এক হোটেলে নেওয়া হয়। পরদিন সকালেই বুঝতে পারলাম আমি প্রতারিত হয়েছি। আমাকে বাধ্য করা হয় যৌন ব্যবসায়। রাজি না হলে মারধর করা হয়। এক রাতে তিনজনেরও বেশি পুরুষের সঙ্গে থাকতে বাধ্য করা হতো।”
তাসনিম কোনওভাবে পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নেন। পরে সরকারের সহায়তায় দেশে ফিরতে সক্ষম হন, কিন্তু তার খালাতো বোন এখনো সেখানে আটকা রয়েছেন বলে জানান তিনি।র‌্যাবের অভিযানে নতুন তথ্য
র‌্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃত চারজন হলেন- ১. মো. রুবেল হোসেন (৩৮), ২. হাসান ঝাং (চীনা নাগরিক), ৩. তানিয়া আক্তার (২৯) ও ৪. রিমা বেগম (৩১)।
তারা স্বীকার করেছেন যে, অন্তত ৪০ জন নারীকে ভুয়া বিয়ের মাধ্যমে চীনে পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি ভিসার জন্য গড়ে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিত তারা। আর বিদেশে পৌঁছে নারীদের কাছ থেকে আরও অর্থ আদায় করা হতো ‘ডকুমেন্ট ক্লিয়ারেন্স’ বা ‘কন্ট্রাক্ট ফি’ নামে।
র‌্যাব আরও জানিয়েছে, এই চক্রের পেছনে একটি আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট কাজ করছে, যারা বাংলাদেশ, চীন ও থাইল্যান্ডে সক্রিয়। চীনে পৌঁছে মেয়েদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়, এরপর তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হয় এমন জায়গায় যেখান থেকে পালানো প্রায় অসম্ভব।
চক্রের নেটওয়ার্ক ও প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষকতা
র‌্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে, এই চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু অসাধু ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, কাজি অফিসের কর্মচারী, এমনকি কয়েকটি এনজিওর নামও জড়িত। তারা বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ‘বৈধ’ করার জন্য নথি জাল করতেন। ভুয়া অভিভাবক হিসেবে কাজ করতেন কিছু অভিনেতা, যাদের প্রতিবার বিয়ের নাটকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হতো।
র‌্যাবের এক কর্মকর্তার ভাষায়, “এটি কেবল মানবপাচার নয়, এটি একটি সংগঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ নেটওয়ার্ক। এতে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি যুক্ত থাকতে পারেন। তদন্তের স্বার্থে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না।”
মানবাধিকার কর্মীদের উদ্বেগ
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপিকা মালেকা বেগম বলেন, “এই ধরনের প্রতারণা আমাদের সমাজের নারীদের নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হুমকি। দারিদ্র্য, কর্মসংস্থানের অভাব ও সামাজিক অসচেতনতা কাজে লাগিয়ে নারীদের ঠকানো হচ্ছে। সরকারকে এখনই কঠোর নজরদারি ও সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে হবে।”
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে ‘বিয়ে বা স্পাউস ভিসা’ দেখিয়ে বিদেশে পাচার হওয়া নারীর সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়েছে। তাদের বেশিরভাগই ফিরতে পারেননি।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও আইনি দিক
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আনিসুল হক বলেন, “বাংলাদেশ দণ্ডবিধি এবং মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে বাস্তবে মামলার সংখ্যা বাড়লেও দণ্ডের হার খুবই কম। তদন্ত ও প্রমাণ সংগ্রহের ঘাটতি রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “স্পাউস ভিসার অপব্যবহার ঠেকাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি। প্রতিটি বিবাহভিত্তিক ভিসার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া আরও কঠোর করতে হবে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা চীনের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। যেসব নারী আটকা পড়েছেন, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে চীনা কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করা হয়েছে যেন এ ধরনের চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়।”
সচেতনতার আহ্বান
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে যাওয়ার আগে ভিসা যাচাই, এজেন্সির নিবন্ধন নম্বর পরীক্ষা ও সরকার অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্টের মাধ্যমে যোগাযোগ ছাড়া কোনো প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়াই নিরাপদ।
নারী অধিকারকর্মী তানিয়া রহমান বলেন, “প্রলোভনের ফাঁদে পড়ার আগে পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করা, প্রস্তাবের সত্যতা যাচাই করা জরুরি। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গড়ে ওঠা সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে।”
‘স্পাউস ভিসা’ এখন এক নতুন মানবপাচারের কৌশল হয়ে উঠেছে। উন্নত জীবনের আশায় পা বাড়ানো অসংখ্য তরুণী অজানার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছেন, যারা হয়তো আর কোনোদিন ফিরতে পারবেন না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী চক্রটি ধরতে সক্ষম হলেও মূল নেটওয়ার্ক এখনো সক্রিয়।
সচেতনতা, কঠোর আইন প্রয়োগ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এই ভয়াবহ প্রবণতা ঠেকানো সম্ভব নয়। প্রতিটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে যেন আর কোনো নারী ‘স্পাউস ভিসা’র নামে প্রতারণার শিকার না হয়।
শীর্ষনিউজ