‘চোখের সামনে পুড়ছিল প্রিয় ক্যাম্পাস। সেই রাতে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে একেকটি ভবন। মেয়েদের হোস্টেলের দিকে যখন ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা আসছিল তখন অনেক ছাত্রী ভয় পেয়ে যায়। কয়েকজন লাফ দিয়ে হোস্টেল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে। আমরা তাদের বাধা দিয়েছি। মেয়েদের হলকে হামলা থেকে রক্ষা করতে আমাদের ছাত্র ভাইয়েরা মানবঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।’
সাভারের আশুলিয়ার খাগন এলাকায় রোববার ঘটে যাওয়া ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের হামলার বিভীষিকাময় ও নির্ঘুম রাতের বর্ণনা এভাবেই দিলেন সিটি ইউনিভার্সিটির ইংরেজি শেষ বর্ষের ছাত্রী সাদিয়া আফরিন। তিনি বলেন, ওই রাতের হামলা, আগুন ও ভাঙচুর দেখে অনেক ছাত্রী এখন ট্রমায় ভুগছেন। আইন বিভাগের ছাত্রী সামিয়া মেহজাবিন ও টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের নাবিলা খানম সুরাইয়া ঘটনার বিষয়ে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে এখন তাদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হচ্ছে।
সেই রাতে ইংরেজি শেষ বর্ষের ছাত্রী কেয়া তাঁর ফেসবুক লাইভে এসে তাদের হোস্টেলকে রক্ষা করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। এরপর সিটি ইউনিভার্সিটির সব ছাত্র দুটি হোস্টেলের সামনে এসে জড়ো হতে থাকে।
সংঘর্ষের জেরে এখন বন্ধ ড্যাফোডিল ও সিটি ইউনিভার্সিটি। গতকাল ওই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায় সুনসান নীরবতা; ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ। হামলা ও সংঘর্ষ নিয়ে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের এখন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলছে। দুপক্ষই লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন চেয়ারম্যানের কাছে। তবে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরে ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ে সিটি ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার বাদী হয়ে গতকাল সাভার মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন। তবে সেটি এখনও মামলা হিসেবে রুজু হয়নি।
এদিকে গতকাল দুপুরে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আর কবির বলেন, পরিকল্পিতভাবে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়ে, টাকা চুরিসহ অন্যান্য দায়ভার আমাদের নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপানো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমাদের মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির গুরুত্ব আমাদের কাছে আছে, তবে বিষয়টি কখনোই মানুষের জীবনের সঙ্গে তুলনাযোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ ব্যাপারে পরবর্তী কাজগুলো করবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
তিনি আরও বলেন, রোববার সন্ধ্যায় সিটি ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থীর গায়ে থুতু নিক্ষেপ করলে বাগ্বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে রাত ৯টার দিকে ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীদের হোস্টেল ব্যাচেলার্স প্যারাডাইসে সংঘবদ্ধভাবে হামলা চালানো হয়। পথেঘাটে শিক্ষার্থীদের আটক করে জিম্মি করা হয়। এ ঘটনায় ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা সিটি ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে তাদের বন্ধুদের উদ্ধারের চেষ্টা করলে সংঘর্ষের সূত্রপাত। সোমবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত সিটি ইউনিভার্সিটির প্রশাসনের নির্দেশে আমাদের শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে রাখা হয়।
উপাচার্য বলেন, ক্ষতির হিসাব কিন্তু শুধু গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ দিয়ে হবে না। হাত ভেঙে যাওয়া, ট্রমাটাইজ হওয়া, মৃত্যুর আশঙ্কা– সবকিছুই ক্ষতির আওতায় আনতে হবে। তদন্ত ফুটেজ ছাড়া আমরা কিছুই বলতে চাই না। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা কাজ করছে এবং নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য আমরা ইউজিসির কাছেও আবেদন করেছি। ইউজিসি একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি করবে।
এদিকে সিটি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. লুৎফর রহমান গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের জানান, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের অভিযোগগুলো সত্য নয়। তারা সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের ভুল তথ্য দিচ্ছেন। আমরা তাদের ছাত্রদের জিম্মি কিংবা আটক করে রাখিনি। যারা ওই দিন রাতে আমাদের প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করতে এসেছিল, তারা আমাদের ছাত্রদের কাছে ধরা খেয়েছিল। তারা প্রতিটি অফিসের কম্পিউটার, ল্যাপটপ এমনকি এসি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় আমাদের ছাত্ররা বিভিন্ন কক্ষ থেকে মোট ১৭ জনকে আটক করে। এ বিষয়কে আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখি, যাতে কোনো ছাত্রের জীবনের ক্ষতি না হয়।
তিনি বলেন, আমরা সকালে এসেই ১৭ জনের মধ্যে আহত ছয়জনকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই। এরপর যারা আহত নয়, এমন ১১ জনকে রেখে দিয়ে তাদের খাওয়া-দাওয়ারও ব্যবস্থা করি। আমাদের ছাত্রদের দাবি ছিল– যারা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এত বড় ক্ষয়ক্ষতি করল, এর সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত ড্যাফোডিল কর্তৃপক্ষ এখানে এসে তাদের নিয়ে যাবে। এরপর আমরা আমাদের ছাত্রদের বুঝিয়ে বেলা ৩টার দিকে তাদের আহতাবস্থায় ড্যাফোডিল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করি।
উপাচার্য বলেন, আমাদের পুরো ক্যাম্পাসকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে এখন উল্টো তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণসহ পুরো ঘটনা তদন্তের জন্য প্রক্টরকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সিটি ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মীর আকতার হোসেন জানান, আমরা এখনও নিরাপদ নই। ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা এভাবে তাণ্ডব চালিয়ে আমাদের সব কিছু তছনছ করে দিয়ে গেল– এ নিয়ে তাদের কোনো অনুশোচনা নেই। তাদের ছাত্রসংখ্যা বেশি। তাই তারা সব সময় আমাদের হুমকি দেয়।
ছাত্র উপদেষ্টা ড. রহমান মাহবুব জানান, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা ক্যাম্পাসের ভেতরে থাকা ফাতেমা ও মোনা ছাত্রী হোস্টেলে হামলা চালাতে গিয়েছিল। আমাদের ছাত্ররা তখন মানবঢাল হয়ে তাদের বোনদের রক্ষা করেছে। ছাত্রী হোস্টেলের গেট ভাঙতে না পেরে তারা পাশের ক্যান্টিন ভেঙে তছনছ করেছে।