Image description

স্বর্ণের বাজারে চলছে চরম অস্থিরতা। হঠাৎ করেই দাম বেড়ে উঠছে রেকর্ড উচ্চতায়, আবার হঠাৎ করে পড়ছে বড় পতনের মুখে। বাজারের এই দোলাচলে স্বর্ণ কেনাতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছেন আসছে মৌসুমে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে যাওয়া পরিবারগুলো। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বর্ণের মূল্য সাময়িকভাবে অস্থিরতা চললেও দীর্ঘমেয়াদে এটি সুরক্ষিত। তাই স্বর্ণ কেনা মানে শুধু বিনিয়োগ নয়, এটি নিরাপত্তারও প্রতীক।

 

 
আগামী ডিসেম্বরে বিয়ে পুরাতন ঢাকার সুরভি দাসের। বিয়ের জন্য মা-ঠাকুমার গহণা রাখা থাকলেও সেগুলো পুরোনো ডিজাইনের হওয়ায় নতুন করে গহনা কেনার কথা ভাবছেন তিনি। তবে বর্তমানে স্বর্ণের বাজারে চলা চরম অস্থিরতায় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তিনি সময় সংবাদকে বলেন, ঘরে আগের কিছু গহনা আছে। তবে নতুন ডিজাইনের গহনা কিনতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু দামের কারণে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। এখন বেশি দামে কিনলে, পরে দাম কমে গেছে আফসোস করতে হবে। আবার পড়ে দাম আরও বেড়ে গেলে, তখন বাড়তি টাকা গুনতে হবে।

 

 

একই অবস্থা স্কুলশিক্ষক ইউসুফ হোসেনের। মেয়ের বিয়ের জন্য গহনা কিনবেন তিনি। তবে বাধ সাধছে চড়া দাম। ইউসুফ হোসেন বলেন, গত কয়েকমাসে স্বর্ণের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে স্বর্ণ এখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে। অতি প্রয়োজনে স্বর্ণ কিনতে হচ্ছে। সাধ থাকলেও বেশি কেনার সাধ্য নেই।

 

স্বর্ণের দাম বেশি হওয়ায় অনেকেই আবার ঝুঁকছেন রুপার দিকে। তেমনই এক ক্রেতা তন্ময়ের সঙ্গে কথা হয় সময় সংবাদের। স্ত্রীকে বিবাহ বার্ষিকীতে উপহার দেয়ার জন্য রুপার নূপূর কিনতে এসেছেন তাঁতিবাজারে। ইচ্ছে ছিল স্বর্ণের চেইনে উপহার দেবে। কিন্তু স্বর্ণের বাড়তি দামের কারণে বাধ্য হয়েছেন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে। তন্ময় বলেন, স্বর্ণের দাম নাগালের মধ্যে নেই। রুপার দাও এখন বাড়তি। তাই বিবাহ বার্ষিকীতে স্ত্রীকে রুপার নূপূরই উপহার দেব ভাবছি।

 

 

বিয়ের মৌসুমে কেমন থাকবে দেশের স্বর্ণের বাজার?

 

 

উপমহাদেশে বিয়ের গহনা হিসেবে প্রাচুর্যের প্রতীক স্বর্ণ। স্বর্ণের গহনা ছাড়া বর্তমান সময়ে বিয়ের অনুষ্ঠান কল্পনাই করা যায় না! মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তের বিয়েতেও কনের অলংকার হিসেবে ন্যূনতম দুয়েক ভরি গহনা কেনার রেওয়াজ আছে।

 

মূলত দেশে শীতকাল তথা নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিকে ধরা হয় বিয়ের মৌসুম হিসেবে। তাই এই সময়টাতে দেশে স্বর্ণালংকারের চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু এবার চিত্রটা হতে পারে অন্যরকম। অস্থির বাজারে হুটহাট দামের বড় উত্থান-পতনের কারণে মুশকিলে পড়েছেন স্বর্ণের ক্রেতা-বিক্রেতারা। এ অবস্থায় গহনা কেনার বিলাসিতায় কতজন করতে পরবেন সেটা নিয়ে মাথাব্যথা স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের। প্রশ্ন উঠছে আসন্ন বিয়ের মৌসুমে কেমন যাবে এই ব্যবসা?

 

বাজারের চলমান অস্থরিতায় স্বর্ণের বেচাকেনা অনেক কমে গেছে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। আর কাজ কমে যাওয়ার আক্ষেপ গহণা তৈরির কারিগরদের কণ্ঠে। পুরাতন ঢাকার তাঁতিবাজারের সজিব জুয়েলার্সের মালিক সজিব বলেন, দাম বাড়ায় বেচাকেনা নেই বললেই চলে। যারাও কিনছেন, সেটিও পরিমাণে অনেক কম। আগামী বিয়ের মৌসুমে বেচাকেনা কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা এখন পরিষ্কারভাবে বলা যাচ্ছে না।

 

রাজধানীর তাঁতিবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী সুরঞ্জন, সারা বছরের বিক্রির একটি বড় অংশ হয় নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে, মানে বিয়ের মৌসুমে। কিন্তু এবার বেচাবিক্রি প্রত্যাশার অর্ধেকও পূরণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।

 

গহনা তৈরির কারিগর দিলীপ বলেন, বিয়ের জন্য মূলত সীতাহারের পাশাপাশি হাতের কাঁকন, গলার চেইন, মাথার টিকলি-টোপর, আঙুলের আংটি কেনেন গ্রাহকরা। আগে বিয়ের মৌসুমগুলোর কয়েকমাস আগে থেকেই কাজের চাপ বাড়তো। তবে এখন দিনের বেশিরভাগ সময়ই বেকার থাকতে হচ্ছে।

 

তাঁতিবাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী ইউসুফ শরীফ বলেন, স্বর্ণ বেচাকেনা যে একদমই নেই, সেটি বলা যাবে না। তবে মন্দা চলছে। যাদের কাছে টাকা আছে তার ঠিকই কিনছে। তবে যাদের হাতে অর্থ তুলনামূলক কিছুটা কম তারা সমস্যায় পড়েছেন। আগে মধ্যবিত্তরা বিয়ের জন্য ৫-৭ ভরি স্বর্ণ কিনলেও, এখন কিনছেন মাত্র ১-২ ভরি।

 

তিনি আরও বলেন, আসছে বিয়ের মৌসুমে বাজার কেমন থাকবে এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে দাম বাড়তে থাকলে ক্রেতাদের ক্রয়ের পরিমাণও কমতে থাকবে। তখন বেচাকেনা হবে ঠিকই, তবে পরিমাণটি কমে যাবে।

 

 

কি বলছে বাজুস?

 

 

দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করে থাকে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। স্বর্ণের বাজারের চলমান এই অস্থিরতায় সংগঠনটি বলছে, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, যুদ্ধ পরিস্থিতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতিসহ নানা কারণে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের টালামাটাল অবস্থা বিরাজ করছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে।

 

বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিংয়ের চেয়ারম্যান ও বাজুসের সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান সময় সংবাদকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চলমান অর্থনৈতিক শাটডাউনই বর্তমানে স্বর্ণের বিশ্ববাজারে অস্থিরতার অন্যতম বড় কারণ। আমেরিকার শাটডাউনের কারণে রিজার্ভ ব্যাংকগুলো ডলারের বদলে স্বর্ণ কিনতে শুরু করে। এই কারণেই স্বর্ণের দাম হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছিল।

 

‘তবে এরপরই হঠাৎ কেরে বিশ্ববাজারে বড় পতন হয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে-যেসব বড় বড় প্রতিষ্ঠান এক্সচেঞ্জ ট্রেড ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছিল, তারা মুনাফা তুলে নিচ্ছে।’ স্বর্ণের দাম ঊর্ধ্বগতির ধারা কবে থাকবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্বে চলমান অস্থিরতা থামলে, স্বর্ণের বিশ্ববাজারের অস্থিরতাও কমে আসবে। যার প্রভাব দেশেও পড়বে। তবে আগের মতো এক লাখ বা দেড় লাখ টাকার পর্যায়ে আর নামবে না; বরং এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকবে, যেখানে মানুষ কেনাকাটা করতে পারবে।

 

বর্তমান অস্থিরতা স্বর্ণ ক্রেতাদের জন্য তেমন কোনো ঝুঁকি তৈরি করবে না বলেও মনে করেন বাজুসের এই কর্মকর্তা। তার মতে, স্বর্ণ কেনা মানে শুধু বিনিয়োগ নয়, এটি নিরাপত্তারও প্রতীক। কেউ বিয়ে বা প্রয়োজনীয় কারণে স্বর্ণ কিনলে তার লোকসানের সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ স্বর্ণ সব সময়ই একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল সম্পদ।

 

‘আসছে বিয়ে মৌসুমে স্বর্ণ কেনার প্রবণতা কিছুটা কমতে পারে। কেউ কেউ রুপার প্রতিও ঝুঁকতে পারে। তবে সবকিছুই নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর। যাদের হাতে অর্থ আছে তারা ঠিকই স্বর্ণ কিনছে, বিয়ের মৌসুমেও কিনবে। তাদের ক্রয়ে তেমন একটা প্রভাব নাও পড়তে পারে। তবে মধ্যবিত্তদের ক্রয়ে স্বর্ণের বাড়তি দাম প্রভাব ফেলবে।’

 

 

দেশে কত দামে বিক্রি হচ্ছে স্বর্ণ?

 

 

সবশেষ ২৬ অক্টোবর রাতে ভরিতে ১ হাজার ৩৯ টাকা কমিয়ে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ২ লাখ ৭ হাজার ৯৫৭ টাকা নির্ধারণ করেছে বাজুস। এছাড়া ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি ১ লাখ ৯৮ হাজার ৪৯৮ টাকা, ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি ১ লাখ ৭০ হাজার ১৪৩ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ১ লাখ ৪১ হাজার ৪৯৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

 

চলতি মাসে এ নিয়ে ৯ বার সমন্বয় করা হয়েছে স্বর্ণের দাম। যেখানে বেড়েছে ৭ বার, আর কমেছে মাত্র ২ বার। এরমধ্যে গত ১৯ অক্টোবর ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চা ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৮২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপরই গত ২২ ও ২৬ অক্টোবর টানা দুই দফায় ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরিতে কমানো হয়েছে মোট ৯ হাজার ৪২৫ টাকা।

 

 

 

আর চলতি বছর মোট ৬৮ বার দেশের বাজারে সমন্বয় করা হয়েছে স্বর্ণের দাম। যেখানে দাম বাড়ানো হয়েছে ৪৮ বার, আর কমেছে মাত্র ২০ বার। এছাড়া ২০২৪ সালে দেশের বাজারে মোট ৬২ বার স্বর্ণের দাম সমন্বয় করা হয়েছিল। যেখানে ৩৫ বার দাম বাড়ানো হয়েছিল, আর কমানো হয়েছিল ২৭ বার।

 

 

সামনে দাম আরও বাড়বে?

 

 

পরিস্থিতি অনেকটাই নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি ও স্থিতিশীলতার ওপর। যদি তারা তাদের অর্থনৈতিক কাঠামো ঠিক রাখতে পারে, তাহলে স্বর্ণের দাম অতিদ্রুত বাড়বে না। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল যে বলেছে ২০২৬ সালের মধ্যে দাম ৫ হাজার ডলার প্রতি আউন্সে যেতে পারে। তবে এটা কেবল একটি পূর্বাভাস, বাস্তবে তা নাও হতে পারে বলে মনে করেন বাজুসের সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান।

 

তিনি বলেন, যদি ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হয় বা ইসরায়েল-হামাস সংঘাত নিয়ন্ত্রণে আসে, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে আমেরিকার ট্যারিফ নীতি এখনও বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে আছে। এসব কারণেই বৈশ্বিক বাজারে উত্তেজনা ও টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। স্বর্ণ এমন একটি ধাতু, যার দাম সাময়িকভাবে কমলেও দীর্ঘমেয়াদে সবসময় নিরাপদ থাকে। দেশে যারা দেড়-দুই মাস আগে স্বর্ণ কিনেছিলেন, তারা এরমধ্যেই প্রায় ২৫-৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভে আছেন। অর্থাৎ হঠৎ করে সম্প্রতি দাম কিছুটা কমলেও; তাতে বড় ক্ষতি হয়নি।

 

বিশ্ব অর্থনীতির চলমান অস্থিরতা কিছুটা কমলে স্বর্ণের দামও এক পর্যায়ে গিয়ে স্থিতিশীল হয়ে যাবে-অর্থাৎ, হঠাৎ করে আর অনেক বাড়বে না, আবার খুব নিচেও নামবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।