রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া প্রণয়ন করেছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। খসড়া প্রস্তাবে এটির নাম ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান) আদেশ’ হতে পারে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে। ওই প্রস্তাব নিয়ে গতকাল বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে আলোচনা করা হলেও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। তবে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে দু-এক দিনের মধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিতে চায় ঐকমত্য কমিশন।
কমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কিত সুপারিশ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পুনরায় সভা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে কমিশন কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। সভায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক।
এ ছাড়া ভার্চুয়ালি অংশ নেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূইয়া।
সভায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিভিন্ন সুপারিশ নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পরামর্শ নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা করা হয়। এসব বিষয়ে কমিশন সদস্য আজ বৃহস্পতিবার সকালে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করবেন। এরপর দুপুর ২টায় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবার আলোচনায় বসবে কমিশন।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চূড়ান্ত হলে সনদে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) স্বাক্ষর করতে পারে জানা গেছে। এনসিপি নেতাদের সঙ্গে সেই আলোচনা হয়েছে কমিশন সদস্যদের। স্বাক্ষরিত সনদ ও বাস্তবায়ন সুপারিশ সরকারের কাছে পাঠানোর আগে এনসিপির স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার জানান, সনদ স্বাক্ষরের বিষয়ে কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এনসিপির পক্ষ থেকে সনদের আইনি ভিত্তিসহ তিন দফা দাবি জানানো হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, গণভোটের বিষয় এবং সনদের বিভিন্ন প্রস্তাবের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ গুরুত্ব পেয়েছে। কমিশন সাংবিধানিক আদেশের ওপর গণভোট এবং আগামী সংসদের দ্বৈত ভূমিকা প্রস্তাবের কথা ভাবছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা এবং বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক প্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে এরই মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে ২৫টি দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে।
তবে এনসিপি ঐকমত্যের সংলাপে অংশ নিলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি ‘স্পষ্ট’ না হওয়ায় স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করে। এ ছাড়া ইতিহাস ‘সঠিকভাবে না আসা’ এবং সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন নিয়ে আপত্তির কারণে বাম ধারার চারটি দল সনদে স্বাক্ষর করেনি। তবে তাদের স্বাক্ষর করানোর বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে।
কমিশন সূত্র জানায়, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে গত সপ্তাহে কমিশনের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের আলোচনা হয়। এসংক্রান্ত খসড়া প্রস্তাব দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেলকে অনুরোধ জানানো হয়। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের দেওয়া খসড়া প্রস্তাব নিয়ে গতকাল কমিশনের বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। খসড়া প্রস্তাবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির প্রশ্নে সাংবিধানিক আদেশ জারির কথা বলা হয়েছে, যার ভিত্তিতে গণভোটের প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়ায় কিভাবে ওই আদেশ জারি হবে এবং আদেশের ওপর কিভাবে গণভোট হবে তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে। এসব বিষয়ে আজ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে দু-এক দিনের মধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিতে চায় ঐকমত্য কমিশন।
এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ কালের কণ্ঠকে জানান, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। তাঁদের পক্ষ থেকে একাধিক খসড়া প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে আলোচনা শেষে প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে। আজ-কালের মধ্যে তা সুপারিশ আকারে সরকারের কাছে পাঠানো হবে। তবে এসব বিষয়ে সরকারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বলে তিনি জানান।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান) আদেশ’ নামের সাংবিধানিক আদেশ জারির প্রস্তাব করা হয়েছে। আদেশটি সংবিধান ও অন্যান্য আইনের পরিপূরক হবে। এই আদেশের ভিত্তি হবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান। গণ-অভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে বিশেষ পরিস্থিতিতে এই আদেশ জারি করা হবে।
আদেশের পরিশিষ্টে থাকবে জুলাই জাতীয় সনদ। ওই আদেশের পর গণভোট হবে। তবে সাংবিধানিক আদেশ কে জারি করবেন, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। একইভাবে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি ও ভিন্নমত) থাকা প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন আদেশে কিভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে, তা চূড়ান্ত করা হয়নি।
জানা গেছে, গণভোটে ভোটারদের জন্য একটিই প্রশ্ন রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ‘আপনি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ সমর্থন করেন কি না?’—এমন প্রশ্ন রাখা যেতে পারে। তবে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে একটি প্রশ্ন এবং নোট অব ডিসেন্ট থাকা প্রস্তাবগুলো নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন রাখার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। গণভোটে জনগণের অনুমোদন পেলে এই আদেশে উল্লেখিত বিধান অনুযায়ী আগামী সংসদে সংস্কার কার্যকর করতে হবে। এ জন্য আগামী সংসদের দ্বৈত ভূমিকা রাখার প্রস্তাব করা হবে।
জুলাই সনদ অনুযায়ী, সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত সংসদ একই সঙ্গে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। তবে গণভোট কখন হবে, সে বিষয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে, দুই ধরনের প্রস্তাব থাকবে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে সরকার।
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশনগুলোর দেওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণয়নের লক্ষ্যে গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। বর্তমানে সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা চলছে। ৩১ অক্টোবর এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে।