
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক (ডিজি) পদে নিয়োগ সামনে রেখে চলছে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের তদবির ও দৌড়ঝাঁপ। কে কাকে ডিঙিয়ে পদটি কবজায় নিতে পারেন-চলছে সেই প্রতিযোগিতা। শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ এই পদে নিয়োগ পেতে তদবির করা একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি, পদোন্নতি ও বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ। শুধু তাই নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি চক্র পদটিতে নিজেদের লোক বসাতে দেনদরবার শুরু করেছে। তদবিরকারীদের মধ্যে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে এগিয়ে আছেন মাউশির এক পরিচালক। এর আগেও কোটি টাকা ঘুস দিয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান হতে চেয়ে আলোচনায় এসেছিলেন এই কর্মকর্তা। এর পরের অবস্থানে তদবিরে এগিয়ে আছেন মাউশির মাধ্যমিক শাখার আরেক পরিচালক। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫ আগস্টের পর ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমল শেষ হলেও শিক্ষা প্রশাসনে স্বচ্ছতা ফিরে আসনি। বর্তমানে মাউশির বেশির ভাগ বদলি হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে। শিক্ষা প্রশাসনে দলীয় প্রভাববিস্তার এবং ‘পছন্দের লোক’ বসাতে কোনো কারণ দেখানো ছাড়াই সদ্য সাবেক ডিজিকে সরিয়ে দেয় মন্ত্রণালয়।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে ডিজি পদ নিয়ে চলমান অনিয়ম, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শুধু শিক্ষাব্যবস্থার শৃঙ্খলা নষ্ট করছে না, বরং শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ এবং প্রশাসনিক কাঠামোয় বিশৃঙ্খলার জন্ম দিচ্ছে। দেশের ভবিষ্যৎ গঠনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে হলে এখনই দলীয়করণহীন, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নিয়োগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
জানা যায়, মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) খান মাইনুদ্দিন সোহেল ১৬তম বিসিএস-এর একজন কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে ১ হাজার ৭০০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তাকে বদলি করে প্রায় ৫১ কোটি টাকার ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এসব লেনদেন সম্পন্ন করছেন তার ঘনিষ্ঠ ইকবাল নামের এক ব্যক্তি। ফ্যাসিস্ট আমলের সরকারের সঙ্গে সমাঝোতা করে আওয়ামীপন্থি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এনায়েতুল করিমের বিশেষ সুবিধা নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন খান মাইনুদ্দিন সোহেল।
ভুক্তভোগী এক শিক্ষকের অভিযোগ থেকে জানা যায়, মাউশির উপপরিচালক বদলির রেট ১৫ থেকে ২০ লাখ, জেলা শিক্ষা অফিসার ৫ থেকে ১০ লাখ, ঢাকায় প্রধান শিক্ষক পদে ৫ লাখ, ঢাকা শহরে যে কোনো স্কুলে ২ লাখ, ঢাকার বাইরে প্রধান শিক্ষক ৩ থেকে ৫ লাখ এবং ঢাকার বাইরে ১ থেকে ২ লাখ টাকা নির্ধারণ ছিল।
এসব অভিযোগের বিষয়ে যুগান্তরকে খান মাইনুদ্দিন সোহেল বলেন, সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ১৪তম বিসিএস-এর কর্মকর্তারা। আমার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ করার জন্য একটা গোষ্ঠী তৎপর। যেহেতু আমিও একজন ডিজি প্রার্থী, তাই আমাকে নিয়ে সমালোচনা থাকাটাই স্বাভাবিক। আর বদলির বিষয়ে অর্থ গ্রহণের বিষয়টি একধরনের গল্প। পদে যতদিন থাকব, এই গল্প থাকবেই।
মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন বিভাগের পরিচালক কাজী আবু কাইয়ুম (শিশির) ১৪তম বিসিএস কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে বিধিবহির্ভূত, বেআইনি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তদন্ত পরিচালনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এছাড়া তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা নিয়ে ৬ জন শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করেন। নিজের লেখা বই প্রকাশনা আয়োজনের নামে দুর্নীতি, মিথ্যাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। পটুয়াখালী সরকারি কলেজে কর্মরত অবস্থায় ২০২৩ সালে ৯০ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। এ কারণে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর ৩(খ) ও ৩(খ) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ ও ‘পলায়ন’-এর বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে তাকে মন্ত্রণালয় থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এছাড়াও অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমতি ছাড়া নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ এবং তদন্ত কার্যক্রম করেন তিনি, যা অভিযোগ প্রতিকার ও ব্যবস্থাপনা ২০১৫ (সংশোধিত ২০১৮)-এর পরিপন্থি। গত বছর ২২ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) পরিচালক অধ্যাপক কাজী মো. আবু কাইয়ুমকে তিন মাসের ব্যবধানে বদলি করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরে তাকে ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করা হয়। এছাড়া কোটি টাকা ঘুসের প্রস্তাব দিয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদ লাভের চেষ্টা করার অভিযোগও রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগের বিষয়ে কাজী আবু কাইয়ুম যুগান্তরকে বলেন, আমার দপ্তরে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফাইল আসে না। তাই অনিয়ম করার কোনো সুযোগ নেই। আমার বিরুদ্ধে মাউশির মাধ্যমিকের পরিচালক ও সাবেক ডিজি ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। ১ কোটি টাকা ঘুসের প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়গুলো সত্য নয়। আমি বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে একজন বঞ্চিত কর্মকর্তা।
শিক্ষায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে শিক্ষা উপদেষ্টার একান্ত সচিব (পিএস) একেএম তাজকির-উজ-জামানের বিরুদ্ধে। ডিজি পদে দেনদরবার নিয়েও অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কোনো সুযোগ নেই আমার। কারা ডিজি হবেন, সেটি যাচাই-বাছাই করবেন উপদেষ্টা। মাউশির ডিজি পদে কোনো টাকার লেনদেন হয়নি। অভিযোগগুলো সত্য নয়। শিক্ষার ফাইল এদিক-সেদিক করার বা প্রভাববিস্তার করার কোনো সুযোগ আমার নেই। সাবেক ডিজি সরানোর বিষয়ে আমি কিছু জানি না।
জানা যায়, মাউশির ডিজি পদের জন্য ৬৩ জন সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা আবেদন করেছেন। এর মধ্যে মাউশির গুরুত্বপূর্ণ উইং পরিচালকসহ আরও কয়েকজন বিতর্কিত কর্মকর্তা ডিজি পদপ্রত্যাশী রয়েছেন। যাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট আমলে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
মাউশির কলেজ ও প্রশাসন উইং পরিচালক অধ্যাপক বিএম আব্দুল হান্নান ১৪তম বিসিএস কর্মকর্তা। তিনি ফ্যাসিস্ট আমলে একজন সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। এ বিষয়ে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি কোনো ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তা নই। সরকার যাকে যোগ্য মনে করবে, তাকে ডিজি পদে দায়িত্ব দেবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মজিবর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মাউশির ডিজি পদপ্রত্যাশীদের আবেদন স্বচ্ছভাবে যাচাই-বাছাই করা হবে। এতে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। আর অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।