Image description
জবি ছাত্রদল নেতা খুন

পুরান ঢাকার আরমানিটোলার নুরবক্স রোডের রৌশান ভিলা (১৫ নম্বর বাড়ি)। ভবনটির তিনতলার সিঁড়ি থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রদলের নেতা মো. জোবায়েদ হোসেনের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনায় এক নারীসহ মোট তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশ ধারণা করছে অন্য দুইজনের প্রেমের বলি হয়ে থাকতে পারেন জোবায়েদ। এর বাইরে রাজনৈতিক টার্গেটকে বিবেচনায় রেখেছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র। প্রাথমিক তদন্ত অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, যে শিক্ষার্থীকে জোবায়েদ প্রাইভেট পড়াতেন তার সঙ্গে অন্য একটি ছেলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ওই ছেলের সঙ্গে মেয়েটির সম্প্রতি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এর জেরেই জোবায়েদ খুন হতে পারেন। তবে জোবায়েদের সহপাঠী ও রাজনৈতিক সহকর্মীরা রাজনীতির বিষয়টিও তদন্তের বিবেচনায় আনার কথা বলছেন। কারণ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে জোবায়েদ পরিচিত মুখ ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের প্রতিবাদ মিছিল থেকে অভিযোগ করা হয়, ৫ই আগস্টের পর থেকে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের হত্যার জন্য একটি ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদলের মেধাবী শিক্ষার্থীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। 

রোববার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আরমানিটোলার নুরবক্স রোডের রৌশান ভিলার ৫ম তলায় ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বর্ষাকে টিউশন পড়াতে গিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়েদ। এর ১৫ মিনিটের মাথায়ই তার বন্ধুদের কাছে খবর আসে জোবায়েদ আর নেই। সাম্য, জাফর, রিয়াজ, শামীমসহ জবি’র শিক্ষার্থীরা ওই রৌশান ভিলায় প্রবেশের পর দেখতে পান- ভবনের তিন তলা থেকে নিচতলা পর্যন্ত রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আর তিনতলার সিঁড়ির উপর পড়ে আছে জোবায়েদের নিথর দেহ। ভবনের দুই তলা ও তিনতলার দরজাতেও রক্তের দাগ স্পষ্ট। কেউ ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা করেছে জোবায়েদকে। মুহূর্তেই শত শত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে পুরো এলাকা ঘিরে স্লোগান দিতে থাকেন। খবর দেয়া হয় বংশাল থানায়। ঘটনাস্থলে পৌঁছান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা। 

ওই বাড়ির আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে,  ঘটনার সময় দুই যুবক দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজনের মাথায় কালো টুপি, গায়ে লাল টি-শার্ট। আরেকজনের গায়ে কালো শার্ট, পরনে সাদা প্যান্ট ও পায়ে সাদা জুতা। তার ঘাড়ে ছিল একটি কালো ব্যাগ। মূলত ওই দুই যুবকই খুন করেছে জোবায়েদকে। তাদের মধ্যে একজন বোরহানুদ্দীন কলেজের  প্রথম বর্ষের মাহির রহমান। যার সঙ্গে গত ৯ বছর যাবৎ প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে জোবায়েদের ওই ছাত্রী বর্ষার। বংশাল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, বর্ষাকে আটকের পর  প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে আমাদের কাছে অনেক তথ্য দিয়েছে। সে বলেছে, পাশাপাশি বাড়িতেই বর্ষা ও মাহিরের বেড়ে ওঠা ছোট থেকে। তাদের মধ্যে ছিল দীর্ঘ প্রেমের সম্পর্ক। কিন্তু সম্প্রতি তাদের সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দেয়। কিছুদিন আগে তাদের সম্পর্কের ভাঙন হয় এবং বর্ষা তার বয়ফ্রেন্ড (প্রেমিক) মাহির রহমানকে জানায়, সে তার টিউশন টিচার জোবায়েদকে পছন্দ করে। তবে জোবায়েদকে সে তার পছন্দের কথা এখনো জানায়নি। এটা জানার পর ক্ষুব্ধ হয় মাহির। কিন্তু এর কোনো কিছুই জানতো না জোবায়েদ। জোবায়েদের সঙ্গে বর্ষার কোনো ধরনের কোনো মেসেজও পাওয়া যায়নি। নিজের অন্তরের ক্ষোভ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে মাহির রেকি করে- কখন জোবায়েদ বর্ষাকে পড়াতে তাদের বাসায় আসে এবং যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে রোববার বর্ষাদের বাসার সিঁড়িতে আগে থেকে ওত পেতে ছিল মাহির রহমান। কালো ব্যাগের মধ্যে ছিল ধারালো ছুরি। আর জোবায়েদ কখন কোথায় আছে, কোন পর্যন্ত এসেছে তা সবই বর্ষার মাধ্যমে জানছিল। যখনই জোবায়েদ বর্ষাদের বাসায় প্রবেশ করে তখনই পেছন থেকে গলায় ছুরি দিয়ে টান দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় মাহির ও তার বন্ধু।  

এদিকে, বেশ কিছুদিন আগে বর্ষার সঙ্গে জোবায়েদের বন্ধু সৈকতের ফেসবুকে পরিচয় হয়। প্রায়ই  সৈকতের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে কথা হতো বর্ষার। জোবায়েদকে হত্যার পর রোববার বিকালে ওই সৈকতকেই বর্ষা মেসেজ করে জোবায়েদের খুনের কথা প্রথম জানায়। এরপরই জোবায়েদের মৃত্যুর খবর জানাজানি হয়।

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ- ডিএমপি’র বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, রোববার রাতে আটকের পর আমরা বর্ষাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। সে সবই বলছে কিন্তু তার মধ্যে কোনো হতাশা বা কান্নার কোনো ছাপ পাওয়া যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় কোনো নার্ভাসনেসও ছিল না তার। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ষাকে চিন্তামুক্ত দেখা গেছে। আমরা এ বিষয়ে আরও তদন্ত করছি। তদন্তের পরই বিস্তারিত বলা যাবে। 

বিষয়টি নিয়ে ডিএমপি’র লালবাগ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামি বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসেন হত্যাকাণ্ডে জড়িত সুনির্দিষ্ট তিনজনকে আটক করা হয়েছে। রোববার রাতেই ওই ভবনের ৫ম তলা থেকে বর্ষাকে আটক করা হয়। এরপর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আরও দুই যুবককে শনাক্ত করা হয়। তাদের আটকে রাতভর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়। পরে সোমবার ভোরে মূল অভিযুক্ত মাহিরকে তার মা থানা পুলিশে হস্তান্তর করে। এ ছাড়াও আমরা পুরো বিষয়টি তদন্ত করছি। এই ঘটনায় আর কেউ জড়িত আছে কিনা সেদিকেও খোঁজ নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও ওই বাড়ির বাকি সদস্যদেরও কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে। 
এদিকে জোবায়েদকে গলা কেটে হত্যা ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজন আটকের পরও পুলিশ এই বিষয়ে মামলা নিতে নানা টালবাহানা করেছে বলে জানিয়েছেন নিহত জোবায়েদের পরিবার।

জোবায়েদের বড় ভাই এনায়েত হোসেন সৈকত বলেছেন, আমরা ছাত্রীসহ ছয়জনের নামে মামলা দিতে চেয়েছি। রোববার রাত ১২টা থেকে মামলা দায়েরের চেষ্টা করছি। কিন্তু বংশাল থানার ওসি এতজনের নামে মামলা না দেয়ার জন্য বলছেন। তিনি বলেছেন- এতজনের নামে মামলা দিলে হালকা হয়ে যাবে। তবে বংশাল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেছেন, আমরা মামলা নিতে প্রস্তুত। পরিবার যাদের নামে মামলা দিতে চায়, আমরা মামলা নেবো। আমরা শুধু বলেছিলাম- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে। গতকাল রাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থানা থেকে মামলার তথ্য মেলেনি।

এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ছাত্রদলের আহ্বায়ক সদস্য মো. জোবায়েদ হোসেনকে হত্যার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখা ছাত্রদল। একই ঘটনায় রাজধানীর পুরান ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মেহেদী হাসান বলেন, ‘জোবায়েদ আমাদের সহযোদ্ধা ছিলেন। তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে মারা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের উদাসীনতা আমাদের মনঃক্ষুণ্ন করেছে। জোবায়েদ হত্যার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল বিক্ষোভ মিছিল করেছে। 
জুবুর মাকে কী করে বোঝাবো জুবু আর নেই: জোবায়েদের বাবা 
ওদিকে আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসেনের জানাজা পূর্ব সমাবেশে বক্তব্য দিতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা মোবারক হোসেন। 

সোমবার দুপুর ২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ প্রাঙ্গণে শিক্ষক শিক্ষার্থী ও দলীয় সহকর্মীদের অংশগ্রহণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জোবায়েদের বাবা মোবারক হোসেন বলেন, আমি জোবায়েদের মাকে কী করে যে বোঝাবো, তার প্রাণের ছেলে জুবু আর দুনিয়াতে নেই। আমার ছেলে বড় হয়েছিল। আমি ঢাকায় ব্যবসার মাল (পণ্য) কিনতে আসলে, সে আমার সঙ্গে থাকতো। আমি তার কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটতাম। মোবারক হোসেন আরও বলেন, আমার ৫৮ বছরের জীবন যৌবনের সব অর্জন শেষ। আমার প্রাণের জোবায়েদ আর নেই। আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই। আর সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন। 

মোবারক হোসেন বলেন, আমার ছেলেকে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আশা করেছিলাম, আমার ছেলে পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে। চাকরি করবে, দেখে আমার আনন্দ লাগবে। কিন্তু আজ আমার ছেলেকে লাশ হিসেবে নিয়ে যাচ্ছি। এটা আমার জন্য কতো যে বেদনার, আমি কী করে বোঝাবো!!
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. শেখ গিয়াসউদ্দিন, প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তাজাম্মুল হক, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির, সহ-সভাপতি কাজী জিয়াউদ্দিন বাসেত, জবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মেহেদী হাসান হিমেল, সদস্য সচিব শামসুল আরেফিন, শাখা শিবিরের সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম, ছাত্র অধিকারের সভাপতি এ কে এম রাকিব,  বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক ফয়সাল মুরাদসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা জানাজায় অংশগ্রহণ করেন।