Image description
পুরোদমে সচল হয়নি কার্গো ব্যবস্থাপনা

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডের তিনদিন পার হলেও এখনো পুরোদমে সচল হয়নি কার্গো ব্যবস্থাপনা। কার্গো ভিলেজের সার্ভার অচল থাকায় আমদানি কার্যক্রম চলছে খাতা-কলমে। ভোগান্তি পোহাচ্ছেন শত শত আমদানিকারক ও এজেন্ট। এর মধ্যেই আজ নামতে যাচ্ছে প্রথম কার্গো ফ্লাইট। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্ভার এবং শেড প্রস্তুত না হলে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া চালানো ঝুঁকিপূর্ণ।

সূত্রমতে, শনিবার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক কার্গো অপারেশন পুনরায় শুরুতে প্রস্তুতি নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে ক্যাথে প্যাসিফিকের (ক্যাথে কার্গো) সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আজ প্রথম কার্গো ফ্লাইট শাহজালালে অবতরণ করবে। সীমিত পরিসরে পণ্য নামানো হবে। এটি মূলত একটি টেস্ট অপারেশন হিসাবে দেখা হচ্ছে। ফ্লাইটের পণ্য ছাড়পত্র হবে আংশিক ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ায়, যেখানে বিমান, কাস্টমস ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের যৌথ দল কাজ করবে।

এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, এখন পর্যন্ত কোনো নতুন কার্গো ফ্লাইট অবতরণ করেনি, তবে মঙ্গলবার থেকে ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সের একটি ফ্রেইটার ফ্লাইট হংকং থেকে ঢাকায় নামার কথা রয়েছে। এটি হবে আগুনের ঘটনার পর প্রথম আন্তর্জাতিক কার্গো ফ্লাইট। প্রথম কার্গো ফ্লাইটে আসবে প্রায় চারশ টন আমদানি পণ্য, যা রাখার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে রপ্তানি ভিলেজের পাশের একটি উন্মুক্ত স্থানে। পণ্য খালাসের পর তা বের হবে নয় নম্বর গেট দিয়ে।

ক্যাথে প্যাসিফিকের এক কর্মকর্তা সোমবার যুগান্তরকে বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডের পর আমরা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। নিরাপত্তা ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের প্রস্তুতি যাচাই শেষে আগামীকাল (আজ) থেকে আমাদের নিয়মিত কার্গো ফ্লাইট পুনরায় শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে পূর্ণ সক্ষমতায় কার্গো কার্যক্রম চালু করা হবে।

সোমবার বিমানবন্দরের ৯ নম্বর গেটে কার্গো গেটে সরেজমিন দেখা যায়, চোখে-মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে খালাস করা পণ্য গ্রহণ করতে অপেক্ষা করছেন ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ), আমদানিকারক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

সিএন্ডএফ এজেন্ট ও ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম মিঠু যুগান্তরকে বলেন, দ্রুত কার্গো ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক না হলে আমদানিকারকরা আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে অক্ষম-এমন নেতিবাচক বার্তা যেতে পারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এতে অন্যান্য দেশ তাদের কার্গো ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্তও নিতে পারে।

আগুনে পুরোপুরি পুড়ে গেছে মূল আমদানি শেড। যেখানে ছিল গুদাম, স্ক্যানিং ও ক্লিয়ারেন্স ব্যবস্থা। এখন বিকল্প হিসাবে রপ্তানি শেডের পাশে একটি ছোট জায়গায় অস্থায়ীভাবে পণ্য নামানো ও হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। তবে স্থান সংকট ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় প্রক্রিয়া চলছে ধীরগতিতে।

এদিকে উন্মুক্ত স্থানে পণ্য রাখা নিয়েও চিন্তিত বিমান কর্তৃপক্ষ। বৃষ্টি হলে পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব একটি শেড নির্মাণের চিন্তা করছে তারা। তবে নিজস্বভাবে শেড নির্মাণ প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় তা বিজিএমইএ-এর পৃষ্ঠপোষকতায় করা হচ্ছে বলে জানা যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, বিকল্প স্থানে খুব সীমিত পরিসরে ৯ নম্বর গেটে কাজ চলছে। ভারী বা ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য আপাতত ছাড় দেওয়া যাচ্ছে না।

সাধারণত প্রতিদিন বিমানবন্দরে এক হাজার টন পর্যন্ত শুকনো পণ্যের ব্যবস্থা করা হয়। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রপ্তানির মৌসুমে এই পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। এখন পুড়ে যাওয়া উপকরণ দ্রুত প্রতিস্থাপন করতে হবে, যা আবারও শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো চাপ বাড়াবে।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএফএফএ) সাবেক সহসভাপতি নুরুল আমিন বলেন, ‘আগুনের কারণে বিপুল পণ্য আটকে যাওয়ায় এ বছর বিমান পরিবহণের চাপ আরও বেড়ে যাবে।’

এদিকে বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে কোনো পণ্য আসার তিন কার্যদিবসের মধ্যেই তা বুঝে নিতে হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য না নিলে প্রতিদিনের জন্য জরিমানা গুনতে হয় সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে। আগে নিয়ম ছিল পণ্য আসার পর আমদানিকারককে অবহিত করা এবং তিন কার্যদিবসের মধ্যে পণ্য খালাস না হলে ২১ কার্যদিবস পর তা বাজেয়াপ্ত হিসাবে গণ্য হতো।

অগ্নিকাণ্ডের পর পরিস্থিতি সামাল দিতে সময়সীমা আরও কঠোর করা হয়েছে। সবকিছু স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা আমদানি পণ্য খালাস কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাও এতে সহায়তা করবে। এছাড়া নতুন নিয়ম অনুযায়ী, পণ্য আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খালাস করতে হবে; অন্যথায় প্রতি ঘণ্টার জন্য অতিরিক্ত চার্জ দিতে হবে আমদানিকারকদের।

বাংলাদেশ বিমানের কার্গো শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, কার্যক্রম গতিশীল রাখতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন থেকে শুক্র ও শনিবারও আমদানি পণ্য ব্যবস্থাপনার কাজ চলবে।

কার্গো ভিলেজের আইটি সিস্টেম আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর থেকে এখনো পুনরুদ্ধার হয়নি। বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, সার্ভার রুমে থাকা নেটওয়ার্কিং যন্ত্রাংশ ও কিছু রেকর্ড সার্ভার পুড়ে গেছে। ফলে ‘কার্গো ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ বন্ধ থাকায় এখন পণ্য ছাড়ের প্রক্রিয়া হচ্ছে হাতে লিখে, যা শুধু ধীরগতির নয়, বরং ভুলের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

একজন আমদানিকারক বলেন, আগে ডিজিটালি সব ক্লিয়ারেন্স হতো। এখন সবকিছু কাগজে হচ্ছে, ভুল হলে দায় নিচ্ছে না কেউ।

বিমান বাংলাদেশের কার্গো শাখার এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রাথমিকভাবে বিকল্প সার্ভার চালু করার চেষ্টা চলছে। সার্ভার রুমের ক্ষতি এতটাই গুরুতর যে নতুন করে কনফিগারেশন করতে হচ্ছে। ডেটা ব্যাকআপ আংশিকভাবে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তবে পুরো কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে। আপাতত আমরা নিজস্ব ল্যাপটপ ও মডেম ব্যবহার করে কাজ চালানোর চেষ্টা করছি।

অগ্নিকাণ্ডের পরপরই ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। তদন্ত এখনো চলমান রয়েছে। তদন্ত কমিটির এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হয়নি, এখনই চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। প্রতিবেদন প্রস্তুত হলে বিস্তারিত জানানো হবে।

এদিকে কার্গো ভিলেজের আগুনের ঘটনায় সোমবার পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন-ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা জোন-৩-এর উপসহকারী পরিচালক মো. আব্দুল মান্নান, কুর্মিটোলা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. নাহিদ মামুন ও ফায়ার সার্ভিস ঢাকা-১৯-এর ওয়্যারহাউজের ইনস্পেকটর মো. তোজাম্মেল হোসেন। সদস্য সচিব করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিনকে। কমিটিকে অবিলম্বে ঘটনাস্থল পরিদর্শনপূর্বক অনুসন্ধান কার্যক্রমের জন্য ১৫ কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়েছে।

এ সময়ের মধ্যে নীতিমালা অনুসারে তদন্ত প্রতিবেদন অধিদপ্তরে দাখিল করতে বলা হয়েছে। এর আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এছাড়া দেশে ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কোর কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে এ কমিটি।