
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলা সীমান্তে মাদকের ভয়াল আগ্রাসন বাড়ছেই। এই দুই উপজেলায় রয়েছে ইয়াবার ৬০টি হটস্পট। এসব স্পট দিয়ে মায়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আনা হচ্ছে, বিক্রিও করা হচ্ছে। তবে বড় অংশ মজুদ করা হচ্ছে দুই উপজেলার রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয়। এসব শিবির থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কঠোর অবস্থান রয়েছে সীমান্তে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কমপক্ষে ১০টি চক্র ইয়াবা পাচার করে এ দেশে নিয়ে আসছে। পাচারে জড়িয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বড় অংশ।
সর্বশেষ গতকাল সোমবার সকালে উখিয়ায় বিজিবির বিশেষ অভিযানে ৩০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল এই তথ্য জানান উখিয়া ৬৪ ব্যাটালিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।
মায়ানমার থেকে এভাবে প্রতিনিয়ত ইয়াবা আনা হচ্ছে। সীমান্ত সূত্র জানায়, বাংলাদেশে পাচার করে আনা ইয়াবার মূল কারখানা মায়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে। একসময় রাজ্যটি মায়ানমার জান্তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। বাংলাদেশে ইয়াবার সরবরাহ বাড়াতে রাখাইনে কমপক্ষে ৩৭টি ইয়াবা কারখানা ছিল। তা আরো বেড়েছে। জান্তা সমর্থিত বাহিনীর সহযোগিতায় ওপারের ইয়াবার ডিলাররা নির্বিঘ্নে বাংলাদেশে পাঠায় ইয়াবার বড় চালান। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ সে দেশের সশস্ত্র বিদ্রোহীগোষ্ঠী আরাকান আর্মির হাতে। আরাকান আর্মি নিজেদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মাদক কারবার জিইয়ে রাখছে। মায়ানমারের রাখাইনভিত্তিক আরো দুটি বড় সশস্ত্র গোষ্ঠী রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এ দুই সংগঠনের রয়েছে কয়েক হাজার সশস্ত্র সদস্য। রাখাইন (আরাকান) ও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের সদস্যরাও সক্রিয় রয়েছে। এ দুই সংগঠনের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা ব্যয় নির্বাহের জন্য মাদক কারবার থেকে আয় করা হচ্ছে। বিশেষ করে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) অন্যতম সংগঠক নবী হোসাইনের নেতৃত্বে বাংলাদেশে ইয়াবার বড় চালান ঢুকছে। রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) পাঁচ বছরে সংগঠিত হয়েছে।
মাদক পাচারের ৬০ হটস্পট : আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উখিয়া ও টেকনাফে মাদক আনা হচ্ছে ৬০টি পয়েন্ট দিয়ে। এর মধ্যে উখিয়ার নাফ নদী ও স্থলপথ সীমান্তে সাতটি, বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী আটটি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিনিয়ত মাদকের চালান ঢুকছে। টেকনাফের নাফ নদীর পাশে ২৬টি এবং বঙ্গোপসাগরতীরের ১৯টি পয়েন্ট দিয়ে মাদক আনা হচ্ছে। এসব পয়েন্ট ছাড়াও নৌপথে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, বরিশালের কুয়াকাটা দিয়েও ইয়াবার চালান আনছে পাচারকারীরা। উখিয়ায় মাদক পাচারের কিছু পয়েন্টের মধ্যে রয়েছে থাইংখালী, পালংখালী, বালুখালী, আমতলী, ডিগলিয়া, পাতাবাড়ি, বঙ্গোপসাগরের ইনানি, পাথুয়ার টেক, সোনার পাড়া ও রেজুখাল। টেকনাফের পয়েন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ, মিস্ত্রিপাড়া, নোয়াপাড়ার মগপাড়া, ঝিনাপাড়া স্লুইস গেট, সাইটপাড়া, আছারবনিয়া, সদর ইউনিয়নের মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়া ও কায়ুকখালী ঘাট। এ ছাড়া রয়েছে নাইট্যংপাড়া, বড়ইতলী, হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া, নেচার পার্ক, লেদা, জাদিমুড়ার জাইল্যাঘাটা, মৌচনী, চৌধুরীপাড়া, ওয়াব্রাং, ফুলের ডেইল, নাটমুড়া পাড়াসহ বিভিন্ন পয়েন্ট। বঙ্গোপসাগরতীরবর্তী পয়েন্টগুলো হচ্ছে সেন্ট মার্টিন, সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ, দক্ষিণ পাড়া, ঘোলার পাড়া, মাঝের পাড়া, হারিয়াখালী, কাটাবনিয়া, হাদুরছড়া পয়েন্ট, মুণ্ডার ডেইল ঘাট, টেকনাফ সদরের লম্বরী ঘাট, তুলাতলী, মিঠাপানির ছড়া ইত্যাদি।
পাচারে জেলেদের ব্যবহার : মায়ানমার থেকে মাদকের চালান পাচারে সাধারণ জেলেদের ব্যবহার করছেন ইয়াবা কারবারিরা। কারবারিদের অনেকেই মায়ানমার থেকে নৌপথে নিরাপদে ইয়াবার চালান দেশে ঢোকানোর জন্য নিজেরাই মাছ ধরার ট্রলার ও নৌকার মালিক হয়েছেন। তাঁদের এসব নৌকা সাগরে মাছ ধরার আড়ালে মায়ানমারের জলসীমায় ঢুকে চালান নিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে দরিদ্র অসহায় জেলেদের ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি বিজিবির কক্সবাজার রামু সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মহি উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশি মাছ ধরার ট্রলারগুলো মায়ানমারের জলসীমায় যায়। সাগরপথে মাদক পাচারে বিজিবির সক্ষমতা না থাকলেও আমরা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীকে সহযোগিতা করছি।’ শাহপরীর দ্বীপের জেলে আজিজ উল্লাহ বলেন, ‘নৌকার মালিকদের একটি অংশ জেলেদের ইয়াবা, আইস, স্বর্ণসহ অবৈধ মালপত্র পাচারে বাধ্য করে। জেলেদের অনেকে নৌকা ও ট্রলারে মাছ ধরা ছেড়ে দিতে চাইলেও মালিকদের প্রভাবে তা ছাড়তে পারেন না।’
ক্যাম্পে মজুদ করা হচ্ছে মাদক : জানা গেছে, মায়ানমার থেকে মাদক পাচারে সীমান্ত পার করতে প্রতি পিস ইয়াবা পাঁচ টাকা, মজুদ করতে সাত টাকা নিয়ে থাকে মধ্যবর্তী একটি চক্র। রোহিঙ্গা শিবিরভিত্তিক এই চক্র মাদকের চালানগুলো সীমান্ত পার করে এপারে নিয়ে আসে। পরে কারবারিদের সঙ্গে বনিবনা হলে সেগুলো প্রতিটি সাত টাকা দরে ক্যাম্পের বিশেষ আস্তানায় মজুদ রাখা হয়। মজুদের সময় মাসের বেশি গড়ালে গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। এভাবে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে মাদক মজুদের কেন্দ্র বানানো হয়েছে। বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের ক্যাম্পের যুবক মোহাম্মদ মুসা বলেন, রোহিঙ্গা ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে বাংলাদেশের ইয়াবা কারবারিদের সম্পর্ক গভীর।
চলছে অভিযান : বিজিবির তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত বিজিবির অভিযানে ৪৬ লাখ ৮৯ হাজার ৩২২ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। ৭০ জনকে আটক এবং ৪৭ জনকে পলাতক আসামি করা হয়েছে। কোস্ট গার্ড চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে প্রায় ৩০ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করেছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টেকনাফ থানায় ৩০৮টি মাদকসংক্রান্ত মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় ৩৬৫ জন আসামিকে আটক করা হয়।
কিছু চিহ্নিত কারবারি : আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় থাকা টেকনাফ সীমান্তে মাদক কারবারিদের মধ্যে রয়েছেন সদর ইউনিয়নের ফরিদ আলম, একরাম, আব্দুর রহমান, আব্দুর রশিদ, আবছার, মো. রফিক, কাদের হোসেন ওরফে পাগলা কাদের, শাকের, রিদুয়ান, ফারুক, রাসেল, আলী আহমদ। এ ছাড়া রয়েছেন আনোয়ার হোসেন, কালাইয়া, ইসলাম, নুরুল কবির, আব্দুল গফুর, আব্দুল আমিন প্রকাশ সাতমাইস্যা, জাকের, মো. তৈয়ুব ওরফে মধু তৈয়ুব, দিদার, শামসুল আলম ওরফে কালা বাম্বু, বাদশা মিয়া, সাদ্দাম হোসেন, শাহাদাত কবির, হাসান আব্দুল্লাহ, সাবরাং ইউনিয়নের কামাল হোসেন, আব্দুল গফুর, মো. ইউনুস সিকদার, মো. রাসেল, হারুন, জসিম উদ্দীন, মো. জুবায়ের, নুরুল আলম, জাহাঙ্গীর আলম, সোলেমান বাদশা, মো. ফারুক, রবিউল আলম রবু, মো. তোফায়েল, আবুল ফয়াজ, আব্দুল মান্নান, হেলাল উদ্দীন, টেকনাফ পৌরসভার সৈয়দ আলম প্রকাশ লাল কিয়ায়া। এ ছাড়া রয়েছেন দেলোয়ার হোসেন, নুরুল কায়েছ, ইসলামাবাদ বর্মায়া জিয়াবুল, রিয়াজ উদ্দিন, শহিদ উল্লাহ, নেজাম উদ্দীন, মনছুর, হ্নীলা ইউনিয়নের রেজাউল করিম, হারুন, সাইফুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন ননাইয়া, শাহ আজম, আবু তালেব, আব্দুর রহমানের নুর, জাফর আলম, মোহাম্মদ রফিক (প্রকাশ লালু), মাজেদ, জুহুরুল আলম, সেলিম, হামিদ হোসেন, শামসুল আলমের ছেলে ইউনুস, আবছার, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের রোহিঙ্গা নবী হোসেন গ্রুপের ডিলার চার বাবুল, মো. ফয়সাল, মো. আমিন ও আব্দুল মান্নান। উখিয়ার মাদক কারবারিদের মধ্যে রয়েছেন পালংখালী ইউনিয়নের মনির হোসেন, মনজুর আলম, জাফরুল ইসলাম (বাবুল), সোলতান আহমদ, সৈয়দুল বশার, বালুখালীর ছোটন, ফরিদ আহমদ, মিজানুর রহমান, বখতিয়ার, হলদিয়া পালংয়ের সোনা আলম, টিটু, মরিচ্যার তাজ উদ্দীন, কুতুপালংয়ের মামুন, থাইংখালীর মামুনুর রশিদ, রত্নাপালংয়ের নুরুল আমিন, ঘুমধুম সীমান্তের জয়নাল আবেদীন, কালা মিজান ও নুর হোসেন।
টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আশিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি। অভিযানে পলাতক আসামিদের আটকের ব্যাপারে গোয়েন্দা তৎপরতা এবং বিজিবির অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’ টেকনাফ মডেল থানার ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নুর বলেন, সীমান্তের মাদক কারবারিদের তালিকা হালনাগাদের কাজ চলছে। তালিকা হালনাগাদের পর কারবারিদের আটক করতে বড় অভিযান শুরু করবে পুলিশ।