
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে সংযুক্ত অতিরিক্ত সচিব এস এম শাকিল আখতারকে গত ৩ আগস্ট পদোন্নতি দিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়েছিল। বিসিএস ১৫তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা ই-মেইলে যোগদানপত্র দিলেও উপদেষ্টার আপত্তির কারণে সশরীরে সচিবের চেয়ারে বসতে পারেননি। এরপর আড়াই মাস পার হলেও শাকিল আখতারের কপালে জোটেনি সচিবের চেয়ার। কারণ বগুড়ায় তাঁর গ্রামের বাড়ি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে সচিবের তালিকায় তাঁর নাম না থাকলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তালিকায় আছে। তবে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে তাঁর সাবেক কর্মস্থল পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে সংযুক্তি দেখানো হয়েছে।
অন্যদিকে সাড়ে ছয় মাস আগে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম বদলি হয়ে গত ২৭ মার্চ যোগ দেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে। এর পর থেকে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগে সচিব নেই।
রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইসমাইল হোসেন। একইভাবে গত ২৭ আগস্ট চাকরি শেষে অবসরে যান স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. সারোয়ার বারী। দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে এই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগেও সচিব নেই। দীর্ঘ ২১ দিন পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সচিব পদায়ন করা হলেও এই মুহূর্তে সচিবশূন্য পাঁচটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
প্রশাসন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তাব্যক্তিদের অদক্ষতা ও দলবাজির কারণে জনপ্রশাসনে পদ-পদায়ন নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে বলে মন্তব্য প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের মতে, মাসের পর মাস সচিব ছাড়াই মন্ত্রণালয় চলছে, অন্যদিকে পদোন্নতি পেয়েও দক্ষ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তারা পদায়ন পাচ্ছেন না। এটা সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও বিশৃঙ্খলার প্রমাণ। তবে বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে প্রশাসনবিষয়ক বহুগ্রন্থের প্রণেতা ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের অদক্ষতা ও দলবাজির ফসল।
তাঁদের রাজনীতি ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কারণে মাসের পর মাস সচিব ছাড়া মন্ত্রণালয় চলছে। অন্যদিকে পদোন্নতি পেয়েও দক্ষ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তারা পদায়ন পাচ্ছেন না। এটা সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও বিশৃঙ্খলার প্রমাণ। অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা ও উদাসীনতার কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সচিব না থাকলে ওই মন্ত্রণালয় ও এর অধীন সংস্থার প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাভাবিকভাবে সরকারি চাকরির বয়স শেষ হওয়ায় গত ১৬ অক্টোবর বস্ত্র ও পাট সচিব আবদুর রউফকে অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) পাঠানো হলেও নতুন কোনো সচিব পদায়ন করা হয়নি। ফলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, পরিকল্পনা বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে বর্তমানে কোনো সচিব নেই। এসব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তারা। নিয়মিত সচিব না থাকায় এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দাপ্তরিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। পরিকল্পনা বিভাগের সচিব ইকবাল আবদুল্লাহ হারুন গত ২৫ সেপ্টেম্বর পিআরএলে গেলে সচিবের রুটির দায়িত্ব পান অতিরিক্ত সচিব এস এম রেজাউল মোস্তফা কামাল। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব এহছানুল হককে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একই পদে বদলি করা হলে ওই বিভাগের সচিবের পদ শুন্য হয়ে পড়ে। এখনো ওই পদে কাউকে পদায়ন করা হয়নি বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে।
এর আগে দুই বছরের জন্য চুক্তিতে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমানকে গত ২১ সেপ্টেম্বর বদলি করে পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে। এর ২১ দিন পর এই পদে বদলি করা হয় চূক্তিতে থাকা সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এহছানুল হককে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত দুই দশকে এক দিনের জন্যও সচিব ছাড়া থাকার নজির নেই। এর আগে প্রায় এক মাস খালি থাকার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি দুজন কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে সচিব হলেও নানা বাধায় সময়মতো চেয়ারে বসতে পারেননি। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রহমান তরফদারকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পদায়ন করা হলেও সচিবের চেয়ারে বসতে পারেননি বিসিএস ১৫তম ব্যাচের ওই কর্মকর্তা। বিষয়টি নিয়ে কালের কণ্ঠে প্রতিবেদন ছাপার পরদিন তাঁকে সরকারি কর্মকমিশনে পদায়ন করা হয়। এর আগে গত ৩ আগস্ট পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে সংযুক্ত অতিরিক্ত সচিব এস এম শাকিল আখতারকে পদোন্নতি দিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি ই-মেইলে যোগদানপত্র দিলেও উপদেষ্টার আপত্তির কারণে সশরীরে সচিবের চেয়ারে বসতে পারেননি। পরে গত ২০ আগস্ট মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব নিয়োগ পান বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের। বিনা বাধায় তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিলেও শাকিল আখতার এখনো সচিবের চেয়ার পাননি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী স্বৈরশাসনের বিদায়ের এক বছর পরও বিশৃঙ্খল প্রশাসনের শৃঙ্খলা ফেরেনি। অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্ব পালনে গাফিলতি যেন স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের সচিব নিয়োগে বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রশাসনে চরদখলের মতো চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতায় নামেন কিছু আমলা। ফ্যাসিবাদের সহযোগী ডিসিদের প্রত্যাহার করে নতুন ডিসি নিয়োগ দিতে গিয়ে ঘটে লঙ্কাকাণ্ড। ডিসি নিয়োগ নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা হাতাহাতি ও ধ্বস্তাধ্বস্তিতে জড়িয়ে পড়েন। জনপ্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে এক ঘণ্টা ওয়াশরুমে আটকে রাখেন ডিসি নিয়োগে বঞ্চিতরা। সর্বশেষ শিক্ষা সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। এমনকি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে একটি দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা অতীতের সব রেওয়াজ ভেঙে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যা এখন আমলাপাড়ায় ‘ওপেন-সিক্রেট’। এর মধ্যে ডিসি নিয়োগে ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠে খোদ জনপ্রশাসন সচিবের বিরুদ্ধে। যদিও এই বিষয়টি তদন্তে প্রমাণিত হয়নি বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।