
দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বড় ধরনের সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদে। এতে সংবিধান ও বিদ্যমান আইন সংশোধনের মাধ্যমে আদালত ব্যবস্থাকে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর রূপে গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। সনদের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে কার্যকরভাবে পৃথক্করণের লক্ষ্যে সুপ্রিমকোর্টের নিজস্ব সচিবালয় থাকবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে। বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এই সচিবালয়ে সংযুক্ত তহবিল থেকে অর্থায়ন করা হবে। এই সচিবালয়ের ওপর অধস্তন আদালতের প্রশাসনিক কার্যক্রম, বাজেট প্রণয়ন, অধস্তন আদালতের বিচারকের পদোন্নতি, বদলি ও শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হবে।
শুক্রবার সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা ও বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে তৈরি জুলাই সনদে সই করে বিএনপি, জামায়াতসহ ২৪টি রাজনৈতিক দল ও জোট। যাতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি গুরুত্ব পায়।
জুলাই সনদে বিচারকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে, জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রকাশ এবং নির্দিষ্ট সময় পর পর তা পর্যালোচনা, হালনাগাদ ও প্রয়োগ করা হবে। সাবেক বিচারপতিদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক সাবেক বিচারপতিদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রকাশ করা হবে। শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা হিসাবে সতর্ক করা ও উপযুক্ত ক্ষেত্রে ‘বিচারপতি’ পদবি ব্যবহার থেকে বারিত করা হবে। সনদে বলা হয়, একটি স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করা হবে।
বিচার বিভাগের জনবল বৃদ্ধির বিষয়ে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগের সব স্তরে বিচারক ও সহায়ক জনবল বৃদ্ধি এবং বিশেষায়িত আদালত স্থাপন করা হবে। বিদ্যমান জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থাকে অধিদপ্তরে রূপান্তর করার আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীদের সম্পত্তির বিবরণ সম্পর্কে এতে বলা হয়েছে, প্রতি তিন বছর পর পর সুপ্রিমকোর্ট এবং অধস্তন আদালতের বিচারক এবং সব আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পত্তির বিবরণ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। এর স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে আনুষঙ্গিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিধান করা হবে। আদালত ব্যবস্থাপনা সংস্কার ও ডিজিটাইজ করার বিষয়ে বলা হয়েছে, মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও হয়রানি নিরসন, স্বচ্ছতা আনয়ন, মামলার খরচ হ্রাস ও বিচারপ্রাপ্তি সহজলভ্য করার জন্য বিভিন্ন বিধি প্রণয়ন, সংশোধন ও সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক নির্দেশনা জারির মাধ্যমে আদালত ব্যবস্থাপনার সংস্কার ও ডিজিটাইজ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
আইনজীবীদের আচরণবিধি নিয়ে সনদে বলা হয়েছে, আইনজীবীদের আচরণবিধি যুগোপযোগীকরণ, জেলাপর্যায়ে বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপন এবং এর প্রধান হিসাবে একজন বিচারককে দায়িত্ব প্রদান করা হবে। অপরদিকে আদালত প্রাঙ্গণে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হবে।
আইনজীবী সমিতি ও বার কাউন্সিল নির্বাচন প্রসঙ্গ বলা হয়েছে, আইনজীবী সমিতি ও বার কাউন্সিল নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এবং নির্বাচন পরিচালনায় দলীয় রাজনীতির প্রভাব বিলোপের জন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট (সহযোগী সংগঠন, অঙ্গ সংগঠন, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ইত্যাদি) আইনজীবীদের কোনো সংগঠনকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না।
বিচারকদের রাজনৈতিক দলীয় আনুগত্য বিষয়ে বলা হয়, বিচারকদের রাজনৈতিক দলীয় আনুগত্য প্রদর্শন বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশকে অসদাচরণ হিসাবে বিবেচনা করে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান করা হবে।
এর আগে গত বুধবার আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা বিচারবিভাগীয় সংস্কার কমিশনের অন্যতম প্রস্তাব ছিল। প্রধান বিচারপতির সংস্কার ভাবনার মধ্যেও এটা আছে। আমরা এ লক্ষ্যে অনেকদূর এগিয়েছি। কিছু বিষয়ে এখনো কিছু মতভিন্নতা আছে। সেটা নিয়ে আরেকটু আলাপের প্রয়োজন রয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অধ্যাদেশটা উপদেষ্টা পরিষদে পেশ করা হবে। উপদেষ্টা পরিষদ যদি মনে করে তাহলে এটা পাশ করা হবে। আমার ধারণা, এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই সুপ্রিমকোর্ট পৃথক সচিবালয় করতে পারব।
প্রসঙ্গত, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার কিছু দোসর দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। জনগণের বিজয়ের ফল হিসাবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ৬টি কমিশনের সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করেন। কমিশন কয়েক দফায় ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৭২টি বৈঠকে মিলিত হয়। আলোচনায় অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোটের সর্বসম্মত ও বৃহত্তর ঐকমত্য এবং কয়েকটি ভিন্নমতসহ মোট ৮৪টি সুপারিশ সংবলিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়ন করা হয়। শুক্রবার রাজনৈতিক দলগুলো এতে আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর করে।