Image description
২৭ ঘণ্টা পর নিভল বিমানবন্দরের আগুন

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে পুরো দেশ চরম শঙ্কিত। এটি অন্য আর ১০টি ঘটনার মতো নয়। বিমানবন্দরে এত বড় অগ্নিকাণ্ড স্বাধীনতার ৫৪ বছরে ঘটেনি। ফলে দেশের মানুষের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারও পুরো বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। যে কারণে বেশ ভালোভাবেই টনক নড়েছে সরকারের। উপদেষ্টা পর্ষদসহ অন্য সংস্থাগুলো এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সামনে রেখে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। নড়েচড়ে বসেছে গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটও। রোববার সকালে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন আইজিপি বাহারুল আলম। সেখানে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে বিমানবন্দরসহ দেশের স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত হয়। কীভাবে নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও ঢেলে সাজানো যায়, তা নির্ধারণ করতে বিকালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বড় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির ওই জরুরি বৈঠকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়াও চট্টগ্রাম ও রূপনগরের আগুনসহ সাম্প্রতিক অন্যান্য অগ্নিকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয় বলে যুগান্তরকে জানান আইজিপি ড. বাহারুল আলম।

বৈঠকে অগ্নিকাণ্ডসংক্রান্ত সার্বিক বিষয়ে একটি বিশেষ কোর কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই কোর কমিটি পরিচালিত হবে স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গণির নেতৃত্বে। নিজস্ব পদ্ধতিতে অনুসন্ধান কাজ চালাবে এই কোর কমিটি। এছাড়া অগ্নিকাণ্ডের কারণ এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ইতঃপূর্বে যেসব কমিটি হয়েছে, সেগুলোর মনিটরিংও করবে কোর কমিটি। কমিটির সদস্যরা দুটি বিষয় বিবেচনায় রেখে কাজ করবে। তাদের প্রাথমিক কাজ হলো সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে দ্রুত তদন্ত শেষ করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ। অন্যটি হলো দীর্ঘ মেয়াদি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তায় কী কী ববস্থা নেওয়া যায়, সে বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায় এসব তথ্য।

এদিকে প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর রোববার বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে কার্গো ভিলেজের আগুন নির্বাপণ ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এর আগে আগুন লাগার সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর শনিবার রাত ৯টা ১৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে ফায়ার সার্ভিস থেকে জানানো হয়েছিল।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা-জানতে চাইলে আইজিপি ড. বাহারুল আলম বলেন, নাশকতা হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। তদন্তের পরই সবকিছু বলা যাবে। বিষয়গুলো নিয়ে এখনো পুলিশ তদন্ত শুরু করেনি। এখন ফায়ার সার্ভিস বা অন্যান্য ইউনিট তদন্ত করছে। তিনি বলেন, আজকের (রোববার) মিটিংয়ের পর পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেসব ঘটনায় অন্যান্য সংস্থার তদন্তের পাশাপাশি পুলিশ পৃথক তদন্তকাজ চালাবে।

বৈঠকে উপস্থিত অপর এক কর্মকর্তা বলেন, সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনো ঝুঁকি আছে কি না, তা নিরূপণ করে দ্রুত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে।

কেপিআইভুক্ত ও অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই স্থানের আগুন নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাপণে দীর্ঘ সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার যুগান্তরকে জানান, সাধারণ আগুনের সঙ্গে এই আগুনের পার্থক্য আছে। সাধারণত যে কক্ষে আগুন লাগে, সেই কক্ষের দরজা ভেঙে ফেললেই গোটা রুমের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হয়। আর এখানে একটি রুমের মধ্যে শতশত কক্ষ ছিল। আমদানিকৃত পণ্যের যে গোডাউনে আগুন লেগেছে, সেখানে গ্রিল দিয়ে অসংখ্য প্রকোষ্ঠ তৈরি করা হয়েছে। প্রকোষ্ঠের একটি গ্রিল ভাঙার পর দেখা যায় দুই ফুট দূরেই আরেকটি গ্রিল। এ কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে।

যুগান্তরের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিমানবন্দর এলাকায় আমাদের নিজস্ব ফায়ার স্টেশন নেই। সেখানকার ফায়ার স্টেশন পরিচালিত হয় সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। শুরুতে তারা চেষ্টা করেছে। তারা ব্যর্থ হওয়ার পর আমাদের জানিয়েছে। তাই ঘটনাস্থলে পৌঁছতে আমাদের সময় লেগেছে। আমরা যে সময়ে গিয়েছি, সেই সময়ে গিয়ে অনুমান করা কঠিন যে কীভাবে আগুন লেগেছে। কারণ, ওই সময় কোয়ার্টার কিলোমিটারজুড়ে আগুন জ্বলছিল।

পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনা তদন্তে ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে পৃথক দুটি কমিটি কাজ করছে। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো নাশকতা কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি যে কয়েকটি আলোচিত অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলোর কোনোটিতেই এখনো নাশকতার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন মহল থেকে নাশকতার অভিযোগ আছে। তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি, তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ শেষে শিগ্গিরই সরকারের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করতে পারব। এছাড়া প্রতিনিয়ত যেসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি, সেগুলো সময়ে সময়ে সরকারকে অবগত করছি।

উল্লেখ্য, শনিবার দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কুরিয়ার ইউনিটে আগুনের সূত্রপাত হয়। বিমানবাহিনীর ফায়ার ইউনিটসহ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ৩৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। এছাড়া পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, আনসার বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট কাজ করে। আগুনে ২৯ জন আহত হন। আহতরা হলেন-ফায়ার সার্ভিসের পাঁচজন, আনসার বাহিনীর ২০ জন, একজন পুলিশ সদস্য, একজন কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী এবং দুইজন স্বেচ্ছাসেবক। আহতদের মধ্যে ১৩ জন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এবং ১৩ জন কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। বাকি তিনজন উত্তরা উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। রোববার ঘটনাস্থলে গিয়ে আলামত সংগ্রহ করে সিআইডির ফরেনসিক ইউনিট।

এদিকে আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির জরুরি সভা শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম সাংবাদিকদের বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে কোর কমিটি গঠন করেছে সরকার। ১২ সদস্যের এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণিকে। ৫ নভেম্বর কোর কমিটি সুপারিশ পেশ করবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টার সভাপতিত্বে সভায় বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া, সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা কথা বলেছি। অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে-এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও অক্ষমতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বুঝতে চেয়েছি কোন প্রতিষ্ঠানের কতটুকু ক্ষমতা ও দুর্বলতা রয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার স্থায়ী নির্দেশিকা (এসওডি) অনুসারে এই সভার আয়োজন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গঠিত কোর কমিটি ৫ নভেম্বর যে প্রতিবেদন দাখিল করবে এবং তাতে যে সুপারিশ পেশ থাকবে, সেই সুপারিশ অনুসারে পরবর্তী পরিকল্পনা নেওয়া হবে।

অতীতেও অগ্নিকাণ্ডের একাধিক ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন এবং সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই সুপারিশ কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে। বিশেষ করে সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সুপারিশ কী ছিল, কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে-এমন প্রশ্নে ফারুক ই আজম বলেন, আজকের বৈঠকে সেই বিষয়গুলোও আলোচনা হয়েছে। কোথায় কী ঘাটতি রয়েছে, তা কোর কমিটি নির্ধারণ করবে এবং তারা কিছু সুপারিশ করবে। সেই সুপারিশগুলোর আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি এমন অভিযোগ রয়েছে-এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে, আবার কিছু অবাস্তবায়িত রয়েছে। কেন এমনটা হলো এবং এর জন্য দায়ী কে, তা নির্ধারণ করতে কোর কমিটিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তারা এ বিষয়ে সুপারিশ করবে।

সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনো ধরনের নাশকতা দেখছেন কি না-এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, তদন্তের আগে আমরা বিষয়টি নাশকতা বা নাশকতা নয়-এমন কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আগে তদন্ত হোক, তদন্তে বেরিয়ে আসবে এগুলো কি সত্যিই অগ্নিকাণ্ড না নাশকতা। দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না-এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আমরা এখনই কোনো মন্তব্য করতে চাই না। এখানে অনেক বিষয় রয়েছে। সে বিষয় সম্পর্কে প্রযুক্তিগতভাবেই আমরা কিছু জানি না। আমাদের প্রযুক্তিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। সব বিষয় নিয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে এবং আশা করি কোর কমিটির তদন্তে সবকিছুর ওপর একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। বিমানবন্দরে অগ্নিনির্বাপণে পরিপূর্ণ ব্যবস্থা ছিল না, তা কিন্তু নয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘাটতিও ছিল। সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ পদ্ধতি রয়েছে। তবে তাদেরও ঘাটতি ছিল। আমরা সবকিছু তদন্ত করে জানতে চাই। কোথায় কী ঘাটতি ছিল।