
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার খবর ফায়ার সার্ভিস পায় শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, মাত্র ২০ মিনিটের মাধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় তারা। একে একে ৩৭টি ইউনিট গিয়ে কাজে যোগ দেয়। আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয় রোববার বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে। এর মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে যায় কার্গো ভিলেজটি। এর আগে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল কারখানায় আগুন লাগে। মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামের আগুনে ১৬ জন নিহত হন। সেই আগুন রোববার সন্ধ্যা পর্যন্তও নেভেনি।
উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনায় আগুন লাগার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে গিয়েও দ্রুত সময়ে আগুন নেভাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। ফলে এ সংস্থার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এদিকে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এসব অগ্নিকাণ্ড নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত নাশকতা সে বিষয়েও বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো অন্ধকারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ড নাশকতা কিনা জানতে চাইলে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজটা করেছি। আগুনের ঘটনায় আমাদের এক্সপার্টাইজ নাই, ভেতরে কাজও করিনি। এ ধরনের দুর্যোগে মূলত আমরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে ভালো থাকে, উদ্ধারকাজ নির্বিঘ্ন হয়, কেউ যাতে বিশৃঙ্খলা না করে এ বিষয়টি দেখি।
তবে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, কার্গো ভিলেজের মাঝখানের যে ভবন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে সেখানে শনিবার কারও থাকার কথা নয়। ফলে কীভাবে আগুন লাগল তার সিসিটিভি ফুটেজ পেলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এদিকে অগ্নিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখনো আন্তর্জাতিক মানের ফায়ার সার্ভিস গড়ে ওঠেনি। এর কারণ আধুনিক প্রযুক্তিগত সরঞ্জামের ঘাটতি ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দেশে এখনো আন্তর্জাতিকমানের ফায়ার সার্ভিস গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে কেমিক্যালের অগ্নিকাণ্ড নেভানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের ঘাটতি রয়েছে। কেমিক্যালের আগুন নেভাতে রোবটিক ফায়ার ফাইটার ও ড্রোনের ব্যবহার করতে হবে। এখানে আমাদের অনেক ঘাটতি আছে। কোন ধরনের আগুন তা না জেনেই ফায়ার ফাইটাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন দিচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথমেই চিহ্নিত করতে হবে কী ধরনের আগুন। ফায়ার ফাইটারকে সেই অনুযায়ী গিয়ার দিতে হবে।
সূত্র বলছে, ফায়ার স্টেশনগুলোতে অগ্নিনির্বাপণে আধুনিক যন্ত্রপাতির ঘাটতি থাকায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন ফাইটাররা। ফায়ার সার্ভিসের জন্য এখন পর্যন্ত সাতটি রোবটিক যন্ত্র আমদানি করা হয়েছে। তার মধ্যে রাজধানীতে চারটি ও চট্টগ্রামে একটি ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া দুটি এখনো বুঝে পায়নি ফায়ার সার্ভিস। এদিকে ২০২০ সাল থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ বন্ধ রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত ১১ বছরে আগুন নেভানোর সময় ফায়ার সার্ভিসের ২৬ জন কর্মী নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যু হয় অগ্নিকাণ্ডস্থলের বিস্ফোরণ থেকে। এ সময় বিস্ফোরণে আহত হন ৩৮৬ কর্মী।
জানা গেছে, ফায়ার সার্ভিসে এ মুহূর্তে কাজ করছেন ১৪ হাজার ৫৭০ জন। সারা দেশে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন রয়েছে ৫৩৭টি। নাম প্রকাশ না করে ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, উন্নত দেশগুলোতে ৯০০ মানুষের জন্য একজন ফায়ার ফাইটার। আর আমাদের দেশে ১৪ হাজার মানুষের জন্য একজন ফায়ার ফাইটার। এছাড়া ফায়ার ফাইটারদের কাজের বৈচিত্র্যও বেড়েছে। ফলে জনবল কম থাকায় এত অধিক সংখ্যক মানুষের সেবা নিশ্চিত করা কঠিন হচ্ছে।
ফায়ার ফাইটার কর্মীরা বলছেন, উন্নত বিশ্বে অগ্নিকাণ্ডের স্থলে গিয়ে প্রথমেই গ্যাস ডিটেক্টর, কেমিক্যাল ডিটেক্টর ব্যবহার করে নিশ্চিত হয় আগুনটি কোন ধরনের। কিন্তু আমাদের দেশে মাত্র ১৫ থেকে ২০টি স্টেশনে এসব ডিটেক্টর রয়েছে। এছাড়া ফায়ার ফাইটারদের পিপি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক কর্মী। তারা বলেন, কর্মীদের ব্যবহৃত একটি পিপি ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ ডিগ্রি তাপমাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা থাকার কথা। কিন্তু গাজীপুরের অগ্নিকাণ্ডে সেই পিপি ১০০ ভাগ পুড়ে গেছে। এর অর্থ পিপিতে ভেজাল আছে। সঠিক মানের পিপি কেনা হয়নি।
ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের সিনিয়র স্টাফ অফিসার (মিডিয়া সেল) মো. শাহজাহান শিকদার যুগান্তরকে বলেন, আমরা আধুনিক হচ্ছি, এ কারণে আমরা যেসব সরঞ্জাম ভবনে ব্যবহার করছি তা হাইলি ফ্লেমাবল বা উচ্চ দার্হ্য। এগুলো অতিদ্রুত আগুন ছড়িয়ে ফেলে এবং আগুন বড় করে ফেলে। কিন্তু এই আধুনিক সরঞ্জামের সঙ্গে সঙ্গে আমরা অগ্নিনির্বাপণের আধুনিক ব্যবস্থা প্রায় ক্ষেত্রে ব্যবহার করছি না। ফলে অল্প সময়ে আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং বড় হয়ে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস যখন দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাচ্ছে তখন আগুন ফুল ডেভেলপ স্টেজে চলে যাচ্ছে, যার কারণে ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লাগছে।