
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে শনিবার (১৮ অক্টোবর) সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দেশের রফতানি খাত এক কঠিন সংকটের মুখে পড়েছে। শুধু প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী হাজার কোটি টাকার মালামাল নষ্ট হয়নি, বরং তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য অপরিহার্য কাঁচামাল, রফতানির জন্য প্রস্তুত পোশাক এবং অসংখ্য উচ্চমূল্যের স্যাম্পল পণ্যও আগুনে পুড়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ইনামুল হক খান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের পর সাংবাদিকদের জানান, এই অগ্নিকাণ্ড অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। দেশের রফতানি বাণিজ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হওয়া মালামালের মধ্যে রয়েছে—উচ্চমূল্যের কাঁচামাল ও স্যাম্পল পণ্য, যা নতুন ব্যবসা ও আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এগুলো হারালে ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক সুযোগও বিপর্যস্ত হবে।
তিনি বলেন, “আমাদের সদস্যদের মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ২০০-২৫০টি কারখানার পণ্য বিমানযোগে রফতানি করা হয়। তাই ক্ষতির পরিমাণ অনুপাতে অনেক বড় হতে পারে। আমরা ইতোমধ্যে সদস্যদের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের তালিকা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছি এবং দ্রুত তথ্য সংগ্রহের জন্য অনলাইন পোর্টাল চালু করেছি।”
বিজিএমইএ’র পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, “আমরা ভেতরে গিয়ে ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি। পুরো ইমপোর্ট সেকশন পুড়ে গেছে। প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে। তবে ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ নিরূপণ করতে কয়েক দিনের মধ্যে বিস্তারিত যাচাই করা প্রয়োজন।” তিনি আরও জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নতুন পণ্যের আমদানি কার্যক্রম দ্রুত শুরু করতে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন এবং আপাতত ৩ নম্বর টার্মিনালের নতুন স্থানে আমদানি পণ্য রাখার ব্যবস্থা করা হবে।
কার্গো ভিলেজের ভেতরের পরিস্থিতি
পরিদর্শনের পর ইনামুল হক খান জানান, আমরা ভেতরে গিয়ে ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি। পুরো আমদানি সেকশন পুড়ে গেছে। এটি পুনরায় সচল করতে কমপক্ষে ১৫ দিন থেকে ১ মাস সময় লাগতে পারে।
ফয়সাল সামাদ আরও জানান, কাস্টমসের সঙ্গে যৌথভাবে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হচ্ছে। শুক্র ও শনিবারও কাজ চলবে। ব্যবসার স্বার্থে এখন আর সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে না। আমরা চাই দ্রুত ব্যবসায়িক কার্যক্রম সচল হোক।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা মনে করেন, এই অগ্নিকাণ্ড শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বিদেশি ক্রেতাদের আস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বিমানযোগে পাঠানো পোশাক সাধারণত অতি জরুরি অর্ডার—যেখানে সময়ই সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। একটি চালান ২৪ ঘণ্টা দেরি হলে পুরো অর্ডার বাতিল হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “এ ধরনের সংবেদনশীল স্থানে এমন দুর্ঘটনা গ্রহণযোগ্য নয়। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক পোশাক কারখানায় ও বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রফতানি উদ্যোক্তাদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতার অংশ, তা তদন্ত করা প্রয়োজন।”
উদ্যোক্তারা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের সরাসরি আর্থিক ক্ষতি প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকারও বেশি, তবে এর দৈর্ঘ্য ও সময়সীমার কারণে ব্যবসায়িক ক্ষতি অনেক গুণ বেশি হতে পারে। এতে ভবিষ্যৎ অর্ডার, আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং রফতানির ধারাবাহিকতা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হতে পারে।
সরকারি পদক্ষেপ
অগ্নিকাণ্ডের পরই অর্থ মন্ত্রণালয় ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে, যা দ্রুত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে প্রতিবেদন দেবে। কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটওয়ারী, অন্য সদস্যরা হলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও ঢাকা কাস্টম হাউসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনকালে নির্দেশ দিয়েছেন—আমদানি করা পণ্য দ্রুত খালাস করার জন্য সময়সীমা ৭২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৩৬ ঘণ্টা করা হবে। এছাড়া কাস্টমসের সঙ্গে যৌথভাবে ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হবে, যাতে পণ্যের জট না হয় এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম দ্রুত পুনরায় সচল হয়। এদিকে বিজিএমইএ পোশাক খাতের বিপুল ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারের কাছে চার দফা দাবি জানিয়েছে—
১. অগ্নিকাণ্ডটি দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, তা দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা।
২. ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা প্রদান।
৩. বন্দরের বর্তমান পরিস্থিতি নির্বিশেষে অন্যান্য শিপমেন্ট কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত করা।
৪. বিমানবন্দরের স্পর্শকাতর এলাকায় রফতানি পণ্যের নিরাপত্তা জোরদার করা, যাতে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে আস্থা পুনঃস্থাপন হয়।
সংগঠনটি সদস্য কারখানাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে—বিমানবন্দরে আমদানিকৃত পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে খালাস সম্পন্ন করতে।
বিজিএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সচিব মেজর (অব.) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “এই পরিস্থিতিতে শিল্পের ক্ষতি কমিয়ে আনতে আমরা সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। বিজিএমইএ আশা করে, দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিলে পোশাক খাতের রফতানি প্রবাহ আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে।’’
অগ্নিকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) সোমবার (২০ অক্টোবর) দুপুর ১২টায় রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলের বলরুমে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেছে। এতে দেশের সংবাদমাধ্যমকে বিস্তারিতভাবে অবহিত করা হবে। ইএবি সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সাংবাদিকদের উপস্থিত থাকার জন্য বিনীতভাবে আহ্বান জানিয়েছেন।
ভবিষ্যৎ ঝুঁকি ও সতর্কবার্তা
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা সতর্ক করে বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক গার্মেন্টস কারখানা ও বিমানবন্দর এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশের তৈরি পোশাক খাত ও অর্থনীতির নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা দ্রুত নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্মূল্যায়ন, অগ্নিনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ড কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি দেশের তৈরি পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ ব্যবসা, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা এবং রফতানি প্রবাহের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে, তবে প্রকৃত পরিমাণ নিরূপণ এবং ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ নির্ভর করছে সরকারের গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের ওপর। দেশের রফতানি খাতের স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক সুনাম রক্ষায় এখন থেকে পদক্ষেপ এবং সতর্কতা অপরিহার্য।