
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘিরে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সুরক্ষিত ও অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড কীভাবে ঘটলো, শুরুতে কেন আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, আমদানি-রপ্তানি পণ্যের এই হাবে কোনো নিরাপত্তা ঘাটতি ছিল কিনা এসব প্রশ্ন সামনে আসছে। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর গতকাল বিকাল ৪টায় পুরোপুরি নির্বাপণের ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস। ততক্ষণে আমদানি কার্গোর হাজার কোটি টাকার পণ্য আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠান। তবে এই অগ্নিকাণ্ড নিয়ে শুরু থেকেই কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস এসোসিয়েশন, প্রত্যক্ষদর্শী, বিভিন্ন মহল এটিকে পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড ও নাশকতা বলেই মন্তব্য করেছেন। বলা হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক চাকা ধ্বংস করে দিয়ে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য এমনটি করছে কোনো মহল।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এখানে মোটাদাগে বেশকিছু বিষয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একটি ছোট আগুন কীভাবে এত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বিমানবন্দরে সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব দমকল বাহিনী রয়েছে। তাদের কার্যালয় থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব একেবারে সন্নিকটে। প্রাথমিকভাবে আগুনের যে অবস্থা ছিল সেটি তাদের পক্ষে নির্বাপণ করা সম্ভব ছিল। অথচ ছাদবিহীন খোলা জায়গার আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ আকারে। আগুন এতটা ভয়াবহ হয়েছিল সেটা নির্বাপণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের ৩৬টি ইউনিট কাজ করেছে। পাশাপাশি সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব দমকল বাহিনী, বিমান, সেনা ও নৌ বাহিনীও কাজ করেছে। আন্তর্জাতিক এই বিমানবন্দরে প্রতি বছরই অগ্নি নিরাপত্তার স্বার্থে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া হয়। ডামি উড়োজাহাজ তৈরি করে সেটিতে আগুন লাগানোর পর ছুটে আসেন বিমানবন্দরের নিজস্ব ফায়ার ইউনিটের অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট ক্রাশ টেন্ডারগুলো। তখন বিমানবন্দরের ফায়ারকর্মীরা ডামি উড়োজাহাজের আগুন নিভিয়ে দেন। কিন্তু শনিবার যখন বাস্তবে কার্গো ভিলেজে আগুন লেগেছে তখন তাদের কর্মক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া অনুমতি না থাকায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ৮ নম্বর গেটে আধাঘণ্টার মতো আটকে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। জরুরি মুহূর্তে যদি অনুমতির জন্য ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আটকে না রেখে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হতো তবে আরও অনেক আগেই আগুন নেভানোর কাজ শুরু করতে পারতেন। ফায়ার সার্ভিসকে অনুমতি না দেয়ায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগুন নিয়ন্ত্রণে বিলম্ব হয়েছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলেছেন, দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকার অভিযোগটি সঠিক নয়। বিমানবন্দরের ভেতরে অগ্নিনির্বাপণে যারা ছিলেন, তারা ঘটনার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই কাজ শুরু করেছেন। এসময় তিনি বলেন, আপনারা জানেন, এটি একটি কেপিআইভুক্ত এলাকা, এখানে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে। একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা আগুনের পূর্ব ও পরবর্তী অবস্থা, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করবে।
আগুন লাগার সময়ের বিষয়ে বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগুন লেগেছে দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে। অপরদিকে ফায়ার সার্ভিস বলছে, তারা আগুন লাগার খবর পেয়েছে ২টা ৩০ মিনিটে। তাদের প্রথম ইউনিটটি ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে ২টা ৫০ মিনিটে। এ হিসাবে আগুন লাগার অন্তত ৩৫ মিনিট পর ফায়ার সার্ভিসের প্রথম গাড়িটি সেখানে পৌঁছেছিল। এরকম একটা স্পর্শকাতর স্থানে আগুন লাগার ৩৫ মিনিট পর কেন ফায়ার সার্ভিস পৌঁছালো সেই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর মিলছে না। ঘটনাস্থলে থাকা ইমরান হোসেন নামে একজন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের দাবি দুপুর ২টার আগেই আগুন লেগেছে। এদিকে, শনিবার ছুটির দিন কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার বিষয় নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
কার্গো ভিলেজের সঙ্গে একেবারে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস এসোসিয়েশন। সংগঠনটি এক বিজ্ঞপ্তিতে বলছে, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস-এটি কেবল দুর্ঘটনা নয় বরং দেশের শিল্পকারখানা, আমদানি-রপ্তানি খাত এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষতি করে জাতীয় অর্থনীতিকে অচলের নীলনকশার অংশ হতে পারে। সংগঠনের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনের জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার। পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তিনি এসময় বিমানবন্দর এলাকায় নিরাপত্তা ও অগ্নি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কার্যকারিতা পুনর্মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও আধুনিকায়ন নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন। বাকি দাবিগুলোর মধ্যে আছে, ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণের পদক্ষেপ নেয়া এবং জরুরি ভিত্তিতে আমদানি পণ্যের নির্মাণাধীন গুদাম অস্থায়ীভাবে চালু করা। সংগঠনটি মনে করে ঘটনাটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম ব্যাহত করার পরিকল্পিত অপচেষ্টার অংশ কিনা, তা বিস্তারিতভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ছাড়া আগুন লাগার পর সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিস যথাসময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করতে অনেকটাই ব্যর্থতার কথা বলা হয়েছে সংগঠনের তরফে।
২৭ ঘণ্টা পর পুরোপুরি আগুন নির্বাপণের ঘোষণা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেনটেইন্যান্স শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, একে একে ৩৭টা ইউনিট এখানে অক্লান্ত পরিশ্রম করে, শনিবার রাত ৯টা ১৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আমরা ৪টা ৫৫ মিনিটে এটা সম্পূর্ণ নির্বাপণ ঘোষণা করেছি। তিনি বলেন, কার্গো ভিলেজের যেই অংশে আগুন লেগেছিল, প্রতিটা জায়গাতেই আসলে খোপ খোপ করে ভাগ করা ছিল এবং ভেতরে অনেকগুলো অংশ স্টিলের তৈরি। স্টিলের স্ট্রাকচার দিয়ে একতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত আছে, যেটার জন্য আমাদের আগুন নেভাতে এত সময় লেগেছে। এখানে যদি অ্যাকটিভ অথবা প্যাসিভ মানে আমাদের যেকোনো ধরনের ডিটেকশন সিস্টেম যদি থাকতো এবং তার সঙ্গে প্রোটেকশন সিস্টেম থাকতো, তাহলে হয়তো এতটা দুর্ঘটনা ঘটতোই না। আমাদেরও তদন্ত করে বের করতে হবে আসলে কখন, কীভাবে এই আগুনটা ধরে। তিনি বলেন, ভেতরে প্রচুর দাহ্য (কম্বাসেবল) ও হ্যাজার্ডাস উপাদান ছিল। এজন্য অকুপেন্সি লোড অনেক বেশি ছিল এবং এ কারণেই আগুন নির্বাপণে অনেক বেশি সময় লেগেছে।
এদিকে, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ সমপ্রতি দেশের নানা জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জরুরি বৈঠকে বসে সরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম-এর সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির এ জরুরি সভা হয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সমপ্রতি দেশের নানা স্থানে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতীয় প্রস্তুতি সংক্রান্ত এ সভা আয়োজন করা হয়।
বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা না দুর্ঘটনা এমন প্রশ্ন উঠেছে অনেকের মাঝেও। বিএনপি’র তরফেও পূর্ব পরিকল্পিত কিনা তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিবৃতি দিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে সমপ্রতি সংঘটিত একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার তা গভীরভাবে অবগত। আমরা সকল নাগরিককে আশ্বস্ত করতে চাই নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে। নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা উস্কানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার সুযোগ দেয়া হবে না।