
নানা জল্পনা-কল্পনা ও টানাপোড়েনের অবসান ঘটিয়ে শেষমেশ বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরাও সই করেছেন এই সনদে। গত শুক্রবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সনদে সই করেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ২৪টি দল ও জোটের নেতারা। বাকি দলগুলো চাইলে পরেও সনদে সই করতে পারবে। তবে কীভাবে সনদ বাস্তবায়ন করা হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। ফলে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা থেকেই গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এদিকে শুক্রবারের সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের শীর্ষ দুই নেতা যোগ দিলেও সেদিন সনদে স্বাক্ষর করেননি তারা। জানা গেছে, আজ রোববার জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে গণফোরাম। পাশাপাশি জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে খুব শিগগির সরকারের কাছে কয়েকটি সুপারিশ করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বর্ধিত সময় অনুযায়ী, ৩১ অক্টোবর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য রয়েছে। তবে সেই ভোট কখন হবে, এ সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। আর যারা সনদে সই করেনি, তারা এই সময়ের মধ্যে সই করতে পারবে।
গত শুক্রবার বিকেলে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২৪টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলেও এর আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা না পাওয়া এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক না করায় সই করেনি এনসিপি। একই দাবি করে আসা জামায়াতে ইসলামী আগের দিন পর্যন্ত সনদ সই করার বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট না করলেও শুক্রবার তাতে সই করেছে। এরপর দলটি বলেছে, বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে তা হবে জাতির সঙ্গে গাদ্দারি।
এনসিপি ছাড়াও ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়া পাঁচটি দল জুলাই সনদে সই করেনি। অন্যদিকে, সনদ স্বাক্ষরকে বড় অগ্রগতি আখ্যা দিয়ে বিএনপি বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় বসতে রাজি তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে জুলাই সনদে সংস্কারের ৮৪টি সিদ্ধান্ত রয়েছে। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ ৯টি মৌলিক সংস্কারে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে। দলটি বলেছে, নির্বাচনে জিতলে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করবে না।
এ ক্ষেত্রে দলটির অবস্থান হলো—সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোটের পর আগামী সংসদে বাস্তবায়ন হবে জুলাই সনদ। আর জামায়াতে ইসলামীর দাবি, সংবিধান আদেশে সনদ কার্যকর করে নির্বাচনের আগে গণভোট হতে হবে। গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট রাখা যাবে না। গণভোটে অনুমোদিত সনদের পুরোটা বাস্তবায়ন করতে হবে আগামী সংসদে।
একই দাবি জানানো এনসিপির অবস্থান হলো, সংবিধান সংস্কারে আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনের কনস্টিটুয়েন্ট (গাঠনিক) ক্ষমতা থাকতে হবে। দলটির মতে, এসব ধাপ নিশ্চিত না করে স্বাক্ষরের নামে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করা রয়েছে। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর শুক্রবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
শুক্রবার স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের ঠিক আগমুহূর্তেও জুলাই সনদ সংশোধন করা হয়। কোন সংস্কারে কোন দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, এর সঙ্গে আরেকটি অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘যে দলের যে বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, তা নির্বাচনী ইশতেহারে রাখা হবে। সেই দল জয়ী হলে নোট অব ডিসেন্ট অনুযায়ী সংস্কার করার এখতিয়ার রাখবে।’ তবে পরে সনদের এই সংস্করণ সরিয়ে ফেলে কমিশন। বিএনপি নোট অব ডিসেন্টে এই প্যারা যুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছে আগে থেকে।
রাজনৈতিক দল ও কমিশন সূত্রের দাবি, সংবিধান আদেশ জারির মাধ্যমে সনদ কার্যকরে সরকারকে সুপারিশ করা হবে।
জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি কী হবে, তা সুপারিশ করা হবে সরকারকে। খুব শিগগির একাধিক বিকল্প দেওয়া হবে। সেখান থেকে সরকার ঠিক করবে কীভাবে সনদ বাস্তবায়ন করা হবে।’
চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম। দীর্ঘ এই আট মাসে দফায় দফায় লাগাতার বৈঠক আর আলোচনার মাধ্যমে এই পর্যন্ত এসেছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে এখনো বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছে আলোচনা। অবশ্য জুলাই সনদ প্রণয়ন ও কার্যকর ইস্যুতে বিশেষজ্ঞরা মোটাদাগে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জুলাই সনদ প্রণয়নের চেয়ে সনদ কার্যকরের পদ্ধতি নিয়েই জটিলতা বেশি। সেইসঙ্গে আইনগত ভিত্তি দিয়ে জুলাই সনদের আলোকে আগামী সংসদ নির্বাচন এবং অতি জরুরি সংস্কারগুলো নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন ইস্যুতে দলগুলোর পরস্পরবিরোধী কঠোর অবস্থানের কারণে সনদ বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা কাটছেই না।
মূলত জুলাই সনদের সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র মতবিরোধ রয়েছে। একদিকে বিএনপিসহ তাদের সমমনা কিছু দল চায় প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন হবে জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী চায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন এবং এর ভিত্তিতে নির্বাচন। ফলে কমিশনের লক্ষ্য কতটা পূরণ হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকছে।
সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মোটাদাগে ছয়টি সুপারিশ পেয়েছিল কমিশন। সেগুলো হচ্ছে—পূর্ণাঙ্গ সনদ বা তার কিছু অংশ নিয়ে গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে বাস্তবায়ন, গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন, ত্রয়োদশ সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন, সংসদকে সংবিধান সংস্কার সভা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সনদের বিষয়গুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে এই মর্মে মতামত চাওয়া যে, অন্তর্বর্তী সরকার এই সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে কি না।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন, জুলাই সনদ নিয়ে সংবিধান আদেশ জারি করা যেতে পারে। এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন সংবিধান আদেশ নিয়ে গণভোট করা যেতে পারে। তারা আরও বলেছেন, সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন টেকসই করতে হলে গণভোট বা গণপরিষদ সবচেয়ে ভালো বিকল্প। গত ১৪ সেপ্টেম্বর দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ জানান, জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবগুলো (ভিন্নমতসহ) চারভাবে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হচ্ছে—অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ। এখন সাংবিধানিক আদেশ এবং গণভোট—এ দুই বিষয়কে ঐকমত্য কমিশন গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এর মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলো গণভোটের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। তবে গণভোটের সময় নিয়ে দলগুলোর মধ্যে এখনো ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে বলে জানা গেছে।
ঐকমত্য কমিশন সূত্রের দাবি, কমিশন সরকারকে বাস্তবায়নের একাধিক বিকল্প পদ্ধতি সুপারিশ করবে।